ফিরোজা রঙের শাড়ি! [Bengali Short Story]

in BDCommunity3 years ago (edited)

ফিরোজা রঙের শাড়ি

img_0.36867246965902295.jpg

Image

কবিরের দেওয়া ফিরোজা রঙের শাড়িটা একটু নেড়ে চেড়ে আবার গুছিয়ে রাখে বকুল। দু'বছরের মেয়েটা পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তখন রাত প্রায় তিনটা বাজে বাজে। গতকাল কবিরের চিঠিটা এসেছে। সারাদিন ছোটাছুটি করেই দিন কাটে নিখাদ গ্রাম্য বধু বকুলের।

ঢাকায় কি একটা অফিসে চোটখাট চাকরি করে কবির। গতকাল চিঠিতে সে লিখেছে, অফিসের কাজের জন্য আজ নিজ জেলায় আসবে। কাজের ফাঁকে বাড়িতেও একবার ঘুরে যাবার ইচ্ছা ওর। গত সাত মাসে একবারও বাড়ি আসতে পারে নি, জীবিকার তাগিদে দিনরাত খাটতে হয় ওকে। বাবা-মা, ভাই-বোন আর বউ বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার এই জীবন সংগ্রামে তার আবিরাম ছুটে চলা যেন চলতেই থাকে।

আজ বাড়ি আসবে কবির, সকাল থেকেই মনটা কেমন যেন করতে থাকে বকুলের।
কতদিন পরে দেখতে পাবে ওকে?
দু'মাস, ছ'মাস নাকি ছ'বছর হল তার মনে নাই যেন।
প্রতিদিনের ঘরকন্নার মাঝে কবিরের অভাব সে পদে পদে টের পায়। আজ ননদকে এটা ওটা করতে বলে, কোলের মেয়েটাকে বাবার আগমনের কথা বারংবার যেন মনে করিয়ে একটু পুলক অনুভব করে বকুল।
-তোর ভাইজানের বাইত আসতে কয়টা বাজবরে ফুলি? জানস কিছু?

ফুলি জবাব দেয়,
রাইতের ট্রেরেনে আইব হুনলাম। আইতে মাইজ রাইত পার অইয়া যাইব। ক্যান ভাবি বড় উতলা হইছ মনে অয়? আঁ?

একটু লজ্জা লজ্জা পায় বকুলের।
ফুলিকে একটা ধমক দিয়ে আবার কাজে মন দেয় ও। আজ মনে পড়ছে ওদের প্রথম প্রনয়ের শিহরিত দিনগুলোর কথা। কত বছর পার হয়ে গেছে তারপর। দিনে দিনে বেড়ে চলেছে মনের টান। ছোট্ট মেয়েটাকে ঘিরে তারা বুনে চলেছে ভবিষ্যতের সপ্নজাল। আর এভাবেই চলছে জীবন।

তখন বাড়ির ছোটরা ছাড়া সবাই মোটামুটি একরকম জেগেই ছিল বলা চলে। শাড়িটা গুছিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছিল বকুল। এমন সময় বাইরের উঠনে ভ্যানের শব্দ আর তার শশুরের হাঁকডাক শোনা গেল। বকুলের মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সি শিহরনের কথা বলতে পারি না। তা ব্যাক্ত করা আমার দুঃসাধ্য। যাই হোক, সারাদিন কতকিছু ভেবেছে বকুল। উৎকন্ঠায় সারাদিন মনের মধ্যে করেছে ছটফট।

উঠোনে পা রাখতেই কবিরের বাবা হারিকেন হাতে বেরিয়ে এলেন। কবির সালাম দিয়ে সবার কুশল জেনে নিল, ইতোমধ্যে তার মাও বের হয়ে এসেছেন। কাপড় চোপড় ছেড়ে হাত মুখে জল দিয়ে উঠোনেই বসল সে। তার মা আনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছেন। খুশির যেন অন্ত নেই।

তিনি হাঁক ছাড়লেন,
-বউমা! ও বউমা....
কবিররে ভাত বাইড়া দেও।
খিদায় বুঝি পরানড়া যায় বাপজানের। কই গেলা বউমা?

রান্নাঘরে বকুল এতক্ষন কবিরের জন্য থালায় ভাত তুলছিল। চোখ ডলতে ডলতে ফুলিও তার ভাইজানের কাছে গিয়ে উপস্তিত হয়েছে। সবাই মোটামুটি ঘিরে ফেলেছে যেন কবিরকে। কত দিন, কত মাস আর বছরের কথা যেন জমিয়ে রেখেছিল সবাই। আজই যেন সব বলে সাবাড় করতে হবে।

তার ও তো অনেক কথা বলবার আছে কবিরকে। কখন যে বলতে পারবে। বকুল ভেবে পায় না। মনের ভেতরে কেমন একটা ছটফটানি চলতে থাকে ওর।

কবির পরম আনন্দের সাথে ভাত খাচ্ছে, পাতে পুঁটি মাছের ঝোল তুলে দিচ্ছে বকুল। আর সবার সাথে এই খাওয়ার মাঝেই গল্প করে চলেছে কবির। সেই অজো পাড়াগাঁয়ে শেষ রাতের চাঁদের আলোয় বসেছে যেন আনন্দের হাট। সুখ বুঝি এরই নাম। ভালোবাসা বুঝি এরই নাম। আহা!

খাওয়া শেষ করে কবির ঘরে ঢোকে আদরের মেয়েটাকে দেখার জন্য। কোলে তুলে চুমু দেয় তাদের জীবনের এই হীরক আনন্দ উপহারকে।
বকুল বলে-
দুইটা দাঁত গজাইছে তোমার মাইয়ার। হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়া অই দুইটার ধার পরখ করে।

হো হো করে হেসে ফেলে কবির। মেয়েকে অব্যাক্ত ভাষায় কি যেন বলে। আদর করে।

হঠাৎ বউকে সে বলে,
ভোরের ট্রেনেই ফিরা যাইতে হইব রে বউ। কাইল সকালে আবার অপিস ধরতে হইব। তুই কষ্ট পাবি জাইনা চিঠিতে তোরে জানাইনাই।

মনটা কষ্টে ভারী হয়ে যায় বকুলের।

আইজ না গেলে হয় না,
কাইল বিয়ানে যাইও,
একদিন অপিস কামাই দেওন যায় না.....

ইত্যাদি অনেক কথায় সে বলে চলে।
কন্ঠ ভারী হতে হতে একসময় কবিরের খেয়াল হয় দু'চোখ ভিজে এসেছে বকুলের।

সান্ত্বনা দিয়ে রওনা দেবার জন্য তাড়া লাগায় কবির। ট্রেন মিস করলে কাল আর ঢাকা ফিরতে পারবে না। ভ্যানটা উঠোনে আবার এসে দাঁড়িয়েছে। বকুল যেন শুনতে পায় কবিরের ব্যাগপত্র তোলা হচ্ছে ভ্যানে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে সবাই বিদায় জানায় কবিরকে। ভ্যান যতক্ষন দেখা যায় উঠোনেই দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। আস্তে আস্তে যেন মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। আর সেই নবজাতক ভোরের হাল্কা আলোয় ফিরোজা রঙের শাড়ি পরে উঠোনের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে পল্লীবধু বকুল।

আর এদিকে কবির ফিরে চলে অজানায়, ফিরে চলে ফিরোজা রঙের শাড়ির মায়ার তোড়কে তুচ্ছ করে।

সমাপ্ত!