দিন যায়, রাত আসে, সন্ধ্যার কালো ছায়া শেষ বিন্দু প্রভাটিকে মুছে দেয়, বেলীফুলের সে সুঘ্রান মেশকের মতো ছাপিয়ে চলেছে চারপাশ, কোনো এক বিস্তীর্ণ মাঠের কিনারে নিশিপরীর দল কার্তিক মাসের চাঁদের আলোয় ঢলে নেমে এসেছে দিগন্তের রেখাটা থেকে শ্মশানঘাটের কিনারে এ পাশটায় যেখানে ব্রীজটার পাশে সারি সারি চোঙা শয়ান দিয়ে আছে মাটিতে। জ্যোৎস্নার পরশে হাসনাহেনা হেসেছে যেন ; ঝিঁ ঝিঁ পোকারা পেয়েছে ছন্দ - আপন আনন্দের অনুভূতি - কি বলে বোঝায় সে পোকার দল?
Source
সবাইকে শান্তির বার্তা ও স্বাগতম জানাই। আশা করি, সবাই সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ভালোই আছি। আজ, কিছুটা রীতিসিদ্ধ লেখার বাইরে গিয়ে এক অন্য ধরনের গল্প লিখবো, যা হয়তো এ পৃথিবীতে খুব সামান্য গুরুত্ব রাখে, যারা এমন এক অন্তঃজ শ্রেণীর অংশ- বিশ্বসংসারের যাদের মূল্য সামান্য ; যাদের নিত্যদিনের লেনাদেনা,যোগাযোগ খুবই নগণ্য, জীবনে বিলাস- নান্দনিকতার লেশমাত্র দেখা হয়ে ওঠে না, পরতে পরতে ক্লেশ,হুতাশ, বন্হিজ্বালা, ক্ষুধা, বেদনা আর অবহেলায় দিন যাপন করা তাদের নিত্যকার কর্ম অনুভূতি।
চলুন, সেই আগের জায়গায় ফিরে যাই, যেখান থেকে এই আয়োজনের শুরু।
এখানে আকাশটা পুরোপুরি নীল, কংক্রিট নেই, নেই কোনো থাই অ্যালুমিনিয়াম গ্লাস, সিরামিক টাইল্স, বার্জার পেইন্ট্সের ছাপ, মোচড় লক্, কিংবা কলিং বেলের স্টেরিওটাইপ মিউজিক যেটা বাজিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে হয়।
আজকালকার ৫ তালার নিচে যেখানে ইমারত খুঁজে পাওয়া কঠিন, সে জায়গাটি থেকে বহুদূরে, ঘুমানোর সময় ছাদের ওপর নিবদ্ধ দৃষ্টি থেকে যেখানে নীলরঙা আকাশটাই যেন একটা মস্ত ছাদ, প্রকৃতি তাকে দিয়েছে, যখন চারপাশের কিছু মানুষ সব কেড়ে নিয়েছে,নিঃস্ব করে দিয়েছে ধনে -সম্পদে,অর্থে, বাড়িঘরে। সে যখন সব হারিয়েছে, তখন প্রকৃতি তাকে দিয়েছে আশ্রয়, যা এখন তার শেষ ঠিকানা।
বলছি একটি ছেলের কথা, পথে যার শুরু - পথে যার ভাগ্য লেখা, উল্টো করে ধরলে পুরো জীবনটাই এখন তার কাছে এক মস্ত খেলা, যার জন্য সব হারিয়ে এইখানে এসে পড়েছে সে। পথ নামক জিনিসটা তার কাছে খুব সহজ মনে হয়, অথচ সে জানে কতটা নিঠুর এই ক্ষেত্র, যার পদে পদে বিপদ, কোনে কোনে লুকিয়ে আছে মরন, জীবজন্তুর আনাগোনা, অচেনা মানুষ যারা নির্দয় হয়ে পরের অনিষ্ট সাধনে তৎপর, চোর-ডাকাতের দল ওঁৎ পেতে শিকারের সন্ধানে। কিন্তু সে ওসব ভয় পায় না, যার কিছু নেই -- তার চোর -ডাকাতকে কিবা দেয়ার আছে?
Source
যে ছেলেটির কথা বলছি, তার নাম বুলবুল। সে অন্যান্য বাচ্চাগুলোর মতো স্কুলে যায় না, চুল উসকোখুসকো, মলিন কাপড়ে রুক্ষভাব, চোখগুলো হালকা কোটরাগত, ঠোঁটজুড়ে সে কি নির্মল এক হাসি, কিছুটা অবজ্ঞার সুর, কিছুটা ব্যাথার অশ্রুজলে সিক্ত, প্রতিটা সকালে, দিনের শুরুতে সে চোঙের ওপর বসে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পথের অদূরে ঝলমলে ইউনিফর্ম পরা তার বয়সী ছেলেমেয়ে, কেউ বাবার হাত ধরে, কেউ বা মায়ের সাথে যাচ্ছে ইস্কুলে, কাঁধে বাঁধা রুপালী -লাল ব্যাগ, তাদের কি ভুবনভোলানো হাসি, কত আনন্দ, খুশি।
বুলবুল চেয়ে চেয়ে দেখে সকালবেলা দূরে দূরে কচিকাঁচারা দলবেঁধে খেলছে, জাতীয় সঙ্গীতের মধুর হাসির রবে আত্নহারা,তারপর পড়াশোনায় বুঁদ হয়ে, দুপুরে টিফিনের ফাঁকে গোল্লাছুট কিংবা গানের কলির আসরে এসে জুটেছে।
কি সুন্দর জীবন, কি অনাবিল তাদের ফুটফুটে উচ্ছাস, নেই কোনো বেদনা - টানাপোড়েন, সারা বেলা শুধু ইস্কুল, তারপর বাড়ি ফেরা। এসব দেখে দেখে সে শুধু নিজেকে কল্পনা করে তাদের মাঝে, কোনো একদিন নিজেকে,তারপর ঘোর কেটে যায়, কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসে। সে তাগিদ অনুভব করে,তার যে খাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে,তেলের শিশি ফেরী করা যে এখনো বাকি, খবরের কাগজ বিক্রি করে দু মুঠো অন্ন জোগানো বাকি!
বুলবুল সে হতভাগ্য একটি ছেলে, যার বুঝতে শেখার বয়সে সে নিজেকে পথের ধারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পেল। বয়স তখন সবেমাত্র এগার কিংবা বারো, হাতে পয়সা নেই, কানাকড়ি নেই, সঙ্গীসাথী কেউ নেই, কেউ দেখভাল করার নেই, সে নিঃস্ব -একাকী, পথের পথিক, অনাথের অধম। ভাগ্যকে সে গালাগাল দিতে শেখেনি তখন, নির্দয় নিষ্ঠুরতা কি জিনিস সেটা শেখার বয়স বোধহয় হয়ে ওঠে নি, এমনই এক দিনের শুরুতে সে তেলের শিশি বিক্রি করার চুক্তি নিল।
সে জানে, তাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, অন্যান্য শিশুদের থেকে বেশখানিটা দূরে।
বর্ষার শেষে তেমনি কোনো এক দিনে রাজপথের চারিধারে কদম ঝরে পড়েছিল, সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে পিলপিল পিপীলিকার মতো, গতিময় সে চলাফেরা, কি সীমাহীন ব্যস্ততা জীবনজুড়ে যেন কোন বিশ্রামের রেশ নেই। বুলবুলের হাতে গোলাপ ফুলের তোড়া, রুপালী লাল প্যাকেটে মোড়ানো বাহারি রঙের বুফে নিয়ে হাঁটছে, বিক্রি করবে আর সে পয়সা দিয়ে নিজের জন্য খাবার কিনে তার নিজের আস্তানায় ফিরবে, এই তার মনোবাসনা।
Source
-লাগবে একটি ফুল,নিবেন?, একদম সস্তা ১০ টাকা, তোড়া ২০ টাকা।
-না, লাগবে না। যাও তো, অন্যখানে গিয়ে বেচগে।
সে নতুন আরেকটি ফুল সাজিয়ে চললো পথ ধরে, মানুষ বুঝে তার ফেরি করার জ্ঞান বাড়তে থাকলো, সে এখন এমন একজনের কাছে যাবে, যারা খুব সম্ভবত ফুল না কিনে থাকবে না। চারুকলা ভবনের পাশ দিয়ে ঠিক উদ্যানে যেখানে এক নবপ্রেমের বুনন চলছে, তাদের সামনে ফুল ফেরি করলো। তারা একটা নয়, তিন তিনটে কিনলো, তার কিছুটা খুশি অনুভূত হলো। কিছুদূর সামনে এগিয়ে দেখলো, সারি সারি মানুষ প্রকৃতি অনুভবে ব্যস্ত,তারা সবাই একটি লাল গোলাপ ছাড়া সব কটি ফুল কিনে নিলো।
বুলবুলের খুশি যেন ধরে না! বহুদিন পর সে খাবার কেনার পাশাপাশি নিজের জন্য একটি শখের জিনিস কিনতে পারবে, তার ছোট ভাইটির জন্য একটি লাটিম - যা সে বায়না ধরেছিল অনেকদিন ধরে। লাটিমজোড়া কিনতেই তার চোখ গড়িয়ে সুরসুর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো! কেন জানি, খুশির কান্না অনেক সময় দুঃখের অশ্রুকে হার মানায়, অনুভবে, আবেগের প্রগাঢ়তায়, মায়ার নিগড়ে - সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না - স্রস্টাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো।
একটি শহরে, কারো জীবননাট্য মঞ্চস্থ হয়, কেউ না কেউ দর্শক বনে যায়। বুলবুল যখন লাটিম কিনছিলো,তখন তার
ঠিক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একটি উচ্চবিত্ত সম্ভ্রান্ত গাড়িচালক তার মালিকের ছোট মেয়েটিকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে ফিরছিলো। মেয়েটির হাফ স্কুল ছিল, তাই দুপুরবেলা সে কিছুটা মন খারাপ করে গোমড়ামুখো হয়ে গাড়ির পিছনে বসে ছিল। সম্ভবত মেয়েটির কোন ভালো বন্ধু জোটে নি দেখে মনে মনে হুতাশ বোধ করছিল।
মেয়েটির স্কুলে সব ধনাঢ্য ছেলেমেয়ে, নামিদামী চকলেট, ইমপোর্টেড ওয়াচ, দামী জামা কাপড়, বাহারী শিক্ষা উপকরন নিয়ে পড়ে থাকে। মেয়রের ছেলে, কিংবা মন্ত্রীর মেয়ে ; বড় শিল্পপতির একমাত্র সন্তানরা তার সহপাঠী, কিন্তু এতগুলে বছর পরেও তাদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়নি। মেয়েটি বুঝেছিল, এরা সবই কৃত্রিম, টাকা অর্থবিত্ত,ধন গৌরবে অহংকারী ; এদের প্রকৃত মন ও জীবন অনুভব নেই। কিন্তু আজ, এতোগুলো বছর পর দেখলো আসল জীবন সংগ্রাম, ঠিক সে যখন দামী খেলনার জন্য মন খারাপ করে,অন্যদিকে দুমুঠো অন্নের জন্য তার মতো একটি মন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনযুদ্ধে নামে।
Source
সে পেয়েছে এমন একজন অচেনা বন্ধু যে নিজের জন্য পয়সা খরচ করে না, তার আদুরে ছোটভাইটির জন্য সযতনে কেনা খেলনা নিয়ে যায়, সে যতই কমদামী হোক, ভালোবেসে দেয়া উপহার, কি দিয়ে কেনা যাবে এ জগতে? মেয়েটি গাড়ির গ্লাসের ভেতর দিয়ে আরো দেখলো, একটি ব্যাকরনের বই কিনছে সে। যেখানে দুবেলা খাবার জোটাতে সে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, প্রাতিস্ঠানিক বিদ্যাশেখা, সে তো গরীবের রকেট লন্চার,কাঙালের হাতিপোষা!
একটি ফুল বুলবুলের হাতে তখনো ছিলো,তার মনে চাইলো এটি কাউকে দিয়ে দেয়, নয়তো ফুল সহজে শুকিয়ে যায়।
তার চেয়ে বরং তাজা ফুলে কারো মন ভালো করে দেয়া যায় কি না। হাঁটতে যেতে যেতে পথে, গাড়িটির পানে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো মেয়েটি তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু সে বলতে পারছে না, মনমরা হয়ে বসে আছে।
সে স্থির করলো ঐ নন্দদুলালীকে ফুলটি দিবে।
গাড়ির জানালার কাচে নক। টক টক টক। গ্লাস খুললো অটোমেটিকালি৷
-এ ফুলটি আপনাকে দিলাম। কেউ মনমরা হলে তাকে ফুল দিতে হয়, তাতে মন ভালো হয়ে যায়.বলেই সে পিছু ফিরলো,সামনে পা বাড়ালো।
মেয়েটি বলে উঠলো, -সে কি! পয়সা নেবে না?,
-সবকিছু পয়সা দিয়ে কেনা যায় বুঝি?
এ প্রশ্নের উত্তর বুলবুল শোনার অপেক্ষা করলো না, সে এখন যথেষ্ট পরিপক্ক। তার আজকের দিনটি মনে গেঁথে রইলো,তার হাতে ছোটভাইটির জন্য একটি উপহার, সে শিখতে চায়, বড় হতে চায়, চায় আলোকিত মানুষ হতে।
জীবন গন্তব্যে যে এখনে অনেক পথ হাঁটা বাকি,অনেক স্বপ্ন বুনতে হবে, দূরে বহুদূরে।
এমনি করে বুলবুল মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেল, মেয়েটি অন্তরে শান্তি অনুভব করলো, ফুলের ঘ্রানে যেন ঢল নেমেছে ভালোলাগাগুলো,প্রানে সে কি আনন্দ ; খুব ছোট কিছুতে মন ভালো হয়ে যায় কখনো, ছোট্ট কিছুতে মনে দাগ কাটে, মন খুশিতে উদ্বেল হয়, হয় নাকি?
Source
Congratulations @asif7! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 500 comments.
Your next target is to reach 500 replies.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!