জনৈক পল্লীবালকের দিনলিপি থেকে...

in BDCommunity3 years ago

জীবনটা দৈর্ঘ্য না কর্মের হিসেবে বড় তার হিসাব কষতে বসলে হয়ত রাত কাবার হয়ে যাবে। মানুষ যখন জীবনের হিসাব মেলাতে যায় তখন অনেক ছোট কিছুর কথা তেমন একটা
গুরুত্ব দেয় না। অংকের যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ আর ধ্রুবকের মারপ্যাঁচে জীবন খাতা যখন হিজিবিজি তখন এই খাতার পুরনো পাতায় তাকিয়ে আজ খুঁজে পেলাম আমার আমিকে।
খাঁটি গ্রাম বলতে যা বুঝায় আমার গ্রামটি তাই।
আমার জন্ম, শৈশব, আর কৈশোরের উচ্ছল দিনগুলো কেটেছে গ্রামের ওই মাটি-বায়ু আর প্রকৃতির সাথে গা মিলিয়ে। শহরের এই ইটের-পাথরের পাহাড়ে তা বহুকাল আগেই উবে গ্যাছে। পুরাতন সৃতিগুলো আজ যেন জীবন্ত হয়ে ভাসছে চোখের সামনে। তাই তো লিখে রাখি যেন, আবার আন্যকোনদিন চোখ বুলালে সুখের পরশটুকু পাওয়া যায়।

img_20150621_094619.jpg

ছোটবেলায় প্রথম রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতার মত জীবন্ত রোমাঞ্চ সৃতি সকলেরই থাকে। তবে আজ অন্য কথা যেন উঁকি দিচ্ছে মনের কোনে। গ্রামের প্রকৃতি আর মানুষের সাথে যেভাবে মিশে ছিলাম আজ সেই কথা মনে পড়ছে খুব। বয়ে যাওয়া ছোট যমুনা কূল আজো আমার মত শহরবাসী পল্লীবালককে কোন অমোঘ আকর্ষণে ডাক দেয় তা জানি না। জানতেও চাইনা হয়ত।
বানের ঘোলা পানিতে গোসল আর দাপাদাপি চলত চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত। নদীর ধারে তরমুজ আজ খিরার ক্ষেত, সরিষা অথবা বাদাম ক্ষেতের আল দিয়ে আমারা দল বেঁধে ঝাপিয়ে পড়তাম নদীতে। মাছ ধরার সঙ্গীরা আজ কে কোথায় কি নিয়ে যে ব্যস্ত আছে তার মালুম নাই।
ঘনকালো মেঘে ঢাকা বর্ষার দিনে সোঁদামাটির গন্ধ্য মনকে কেমন যেন উদাস করে দিত। আজো ওই গন্ধ্য খুঁজে ফিরি। হয়ত নাকটাই এখন নষ্ট হয়ে গেছে।
ডাংগুলি খেলতে আমার তেমন একটা ভালো না লাগলেও গোল্লাছুট, লুকোচুরি, ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম খুব করে। খেলা খেলায় হয়ত নতুন কোন খেলা চালু হয়ে যেত। সারাটা বিকাল নিজের সবটুকু প্রাণশক্তি খুইয়ে যে আনন্দ নিয়ে বাড়িতে ফিরতাম তা শুধু ঐ আমিই জানে। আজ ঐ ভালোলাগা হয়ত মনের কোন কোনে ঘুমিয়ে থাকে চুপচাপ। ব্যস্ততার এই জীবনচাকায় সে আজ পৃষ্ঠ, মাঝে মাঝে উঁকি দেয় মনের কোন থেকে। ডেকে যায় ঐ আনন্দমুখর আর নির্ভাবনার শৈশবে।
রুপকথার গল্পরা আজ যেন অচিনপুরের পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে কোন এক ফুল-পরীর দেশে আস্তানা পেতেছে। সেখানে রাজকুমার, রাজকুমারী আর ফুলপরীরা আজো হয়ত কোন এক নতুন গল্পে সদর্পে বিচরণ করে চলেছে। গল্প বলত আমার দাদি। উঠানে মাদুর পেতে তিনি যখন তার গল্পের শিশি খুলে বসতেন তখন আমিসহ তার ডজনখানেক নাতি নাতনী ঘিরে থাকতাম। আহা আমার সপ্নের মত সেই দিনগুলো।
মেলায় যাওয়ার সৃতি বর্ণনা করা মুশকিল। এতই উৎসাহ আর উত্তেজনা কাজ করত যে মেলায় গেলে চোখটা কেমন ধাঁদিয়ে যেত। খাবার তো আছেই সাথে আছে হরেক রকম চোখ ধাঁধানো জিনিস। আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম একটা বন্দুক, বল, খেলনা গাড়ী, বাঁশী, টুপি কেনার আর নাগোরদোলা, চরকি তো থাকছেই। মেলার ধুলায় মলিন হয়ে আমারা যে কি আনন্দে বাড়ী ফিরতাম তা লিখে বুঝা বা বোঝানো দুটোই অসম্ভব।
পাশে রাখা চায়ের কাপটা কখন যে জুড়িয়ে জল হয়ে গ্যাছে। কি লিখে যাচ্ছি বুঝতে পারছিনা। রাতটাও বাড়ছে।
ডাইরির এই পাতাটাও শেষ।

থাক তুমি
পুরোনো কথা রঙিন হয়ে
মনের কোন কোনে
আমি কান পেতে রই
দেউড়ীতে বসে রই।
আগল খুলে
খোঁজ নিও,
খুঁজে নিও
হে আমার
আনন্দ শৈশব।