মেয়েদের শাড়ি পরা প্রসঙ্গে সেদিন এক গন্ডির ভেতরের পরিচিতকে বলতে শুনলাম, যার সারমর্ম হলো-
"মেয়ে যদি শাড়ি পড়া হয় তাইলে নাকি...সহজে হাত ধরন যায়না, কবিতা শোনান যায় মাঝ রাইতে, গান শোনায়।
তাগো লগে প্রেম করন যায়না কিন্তু মন ভইরা ভালবাসন যায়!"
আমার কৌতূহল হলো, যে তাহলে যেই মেয়ে বা মহিলারা "শাড়ি'র সাথে আড়ি" নেয়া, তাদেরকে ভালবাসা যায়না? প্রেম করা যায় শুধু? আর এই প্রেম আর ভালবাসার মধ্যে তফাৎ-ই বা এলো কবে এ বঙ্গে!
মেয়ে শাড়ি না পরলে প্রেম আসে, ভালবাসা না!
তা এই প্রেমটা কি কেবলই শরীর কেন্দ্রিক সেটা বুঝালো? আর ভালবাসাটা কি তাহলে আপাদমস্তক প্লেটোনিক!?
ঈশ্বর রক্ষা করো!অকাট মূর্খদের করূণারও অযোগ্য এই ঠনঠনে ভালবাসা থেকে আমাকে রক্ষাই করো বৈকি!
মেয়ে অইরকম না দেখতে হলে আবেগ আসেনা;
তইরকম না সাজলে হলে মায়া বসেনা;
পইরকম না হইলে প্রেম করা যায় শুধু, ঘর করা যায়না!
এইরকম মেয়েদের-কেমন-হওয়া-উচিৎ তত্ত্ব বেচে একদল বোদ্ধা হয়, আর আরেকদল গোঁয়ার গোঁড়া দল তাতে স্লোগান সমেতো "সহমত" জ্ঞাপন করে!
ঠিকইতো! মেয়ে অমনই হওয়া উচিৎ, তমনই চলা উচিৎ, এইরকম মেয়েদেরই কেবল ভালবাসা যায়, অইরম হইলে প্রেম করা যায় সংসার না.... ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ফেনা তুলে ফেলছে সব জাগায়।
না শাড়ি নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই! শাড়ি সুন্দর জিনিস। বাঙালির ঐতিহ্য'র অংশ। শাড়ির রঙ ঢঙ আমারও ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে সাধও হয় শাড়ি-চুড়ি পরবার, কদাচিৎ কারো পাল্লায় পড়ে পরাও হয়!
আর সেই জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি শাড়ি'র ভক্ত না হলেও, শাড়িকে আমি এক প্রকার সমীই করি।
কিন্তু অই বাক্যটার অসূয়া আমাকে বেশ আঘাত করেছে। কারণ আমার সহ আরো অনেক অনেক নারীর স্বাভাবিক পোষাক শাড়ি না, এবং শাড়িতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বা আনন্দ কোনোটাই খুঁজে পাইনা।
কিন্তু শাড়ি দিয়ে নারীদেরকে নিজস্ব ধারায় মুড়িয়ে ফেলার এই চরম উন্নাসিকতাকে আমি প্রচন্ড ক্ষোভের সাথে দেখি।
সেই একই ধারণা আমার বোরখ'র প্রতিও।
আমি বোরখাকে পোশাকের চোখেই দেখি। এবং শাড়িও একটা পোশাক আর সব পোশাকের মত।
এইগুলাকে নিজস্ব জাতা পাতের দোহাই দিয়ে ওহী সম্বলিত আসমানি পোশাক বানিয়ে সেই পোশাকে মেয়েদের চলন-বলন-ধরন নির্ধারণ করে দেয়াটা চরম উন্নাসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
কাকে, কিভাবে, কোন পোশাকে ভালবাসা যায় আর কোন পোশাকে শুধুই প্রেম করা যায় আর সংসারী মেয়ে হয় তা কিভাবে সংগায়িত করে কেউ!
আশ্চর্য!
মানে দিনশেষে আমার কৌতুককর কৌতূহল সে দলের প্রতি-
জিন্স পরা,টি শার্ট পরা মেয়েগুলা কি গান গায়না? কবিতা পছন্দ করেনা? ভালবাসেনা?
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে সুহৃদকে নির্ভেজাল একটা প্রশ্ন করার ইচ্ছে দমন করতে পারলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম-
"আচ্ছা তা সেই শাড়ি পড়া মেয়েদের যে কেবলই ভালোবাসবা তোমরা, তা কি কেবলই প্লেটোনিক লাভ হবে নাকি? মানে বলতে চাচ্ছো আজীবন তাকে দেবী'র আসনে পূজাই করবা, সে শাড়ি আর খুলবানা!?"
হঠাৎ এরকম নির্ভেজাল প্রশ্ন শুনে বেচারা খুব থতমত খাবে তা বলাই বাহুল্য! সে বুঝানোর চেষ্টা করলো আমাকে মীন করে কিছু বলেনি! এমনিই আজকালকার প্রজন্মের কথা বলছে। আর তাছাড়া শাড়ির ব্যাপারটাই অন্য রকম, কত কাব্যিকতা, কত শৈল্পিকতা তাতে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
সারমর্ম হলো-
না! শাড়ি পরা মেয়েকে ভালবাসা যায়, বললেও সে ভালবাসা কেবলই প্লেটোনিক নয়! সেটাও আর আব স্বাভাবিক প্রেমের মত।
সেখানে শরীর, প্রাণ, মন সবটারই আদান-প্রদান থাকে।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ফেরার পথে বললাম-
"আচ্ছা! তাহলে মোদ্দা কথা হচ্ছে কিছু বাঙালি পুরুষের সুপ্ত ফ্যান্টাসি হচ্ছে শাড়িতে মোড়া নারীকে উন্মুক্ত করতে চাওয়া!"
আর এটাকেই গ্লোরিফাই করা হচ্ছে "শালীনিভাবে"।
ওটা বন্ধ করুন। খুব জঘন্য।
মেয়েদেরকে নানান রঙে, নানান ঢঙে সীমাবদ্ধভাবে সঙ্গায়িত করা বন্ধ করুন।
সবাইকে কিন্তু শাড়িতে মানায় না। কিন্তু ঐযে বিভিন্ন কবিরা মেয়েদের সাথে শাড়ীকে আষ্টেপৃষ্ঠে যেভাবে জরিয়ে দিয়েছে তাই আমাদের ভাবনা শাড়ি পরলেই মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। শাড়ি পরা হচ্ছে বিরিয়ানির মতো আর বাকিসব পোশাক তো নিত্যদিনের খাবার। যাতেই সকল শান্তি। আর ভালবাসলে সে সব ভাবেই সুন্দর।
সেইতো!
শাড়ি সুন্দরই বটে। একটা অনন্য সাধারণ পোশাক।
কিন্তু এটা দিয়ে নারীকে জড়িয়ে "নারীত্ব" সংগায়িত করার ব্যাপারটাকে "শৈল্পিক" তকমা দেয়াটাই সমস্যা।