মহাভারতের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্রগুলোর মাঝে অন্যতম সম্ভবত, অঙ্গরাজ কর্ণ।
দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসজাত ও মাতা কুন্তি'র অস্বীকৃত, প্রথম সন্তান।
পান্ডবদের মধ্যে জেষ্ঠ্য,
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নয়, কর্ণ, আমাদের রাধেয়।
একটু স্বল্প ধারণা পেতে চাইলে-
হস্তিনাপুর আখ্যানঃ উপসর্গ
হস্তিনাপুর আখ্যান-২ঃ দ্রৌপদী
বিনা বাক্যবাণে এক বা দ্বিপাক্ষিক যেভাবেই হোক, মহাভারতের খল চরিত্রর কথা বললে শকুনি বা দুর্যোধনের উপর সে দায় চাপিয়ে দেয়া যায়।
কিন্তু কর্ণ'র ব্যাপারটা একটু দ্বিধার।
কর্ণকে যেমন নায়কোচিত চরিত্রে কাতারে ফেলা যায়না আবার একেবারে খল চরিত্রের মোহরও মারা যায়না।
কেবল কর্ণকে কেন্দ্র করে মহাভারত দেখলে মনে হবে, বাবা দেবরাজ ইন্দ্র, মা স্বয়ং কুন্তি হবার পরও
এক অর্বাচীন অভিমান আর অন্তর্দাহের দূর্ভাগ্যে পুড়ে গ্যাছে সে সত্ত্বা, আজন্ম।
যেনো স্বয়ং বেদব্যাস নিজেও এই অন্তর্দ্বন্দের টানাপোড়েনে ভুগছিলেন কর্ণকে নিয়ে।
"রাধেয়" বই সংক্ষেপঃ
বিয়ের আগের সন্তান বলে কুন্তিকে বর্জন করতে হয় সন্তানকে।
কিন্তু সে ছোট্ট শিশুকে কোলে তুলে নেয়, আর্যাবর্তের এক সূত পরিবার, অধিরথ আর রাধা।
মাতৃত্বের স্বাদে তৃপ্ত রাধা, সস্নেহে পুত্রর নাম রাখলেন রাধেয়!
দুজনেই ছেলেকে চোখে হারায় একদম।
কিন্তু ছেলে যত বড় হতে থাকে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে।
রাধেয়'র ইচ্ছে সে তীরন্দাজ হবে, অস্ত্রচালনা শিখবে।
কিন্তু সেই সময়ে আর্যাবর্তে নিষিদ্ধ, অলঙ্ঘনীয় নিয়ম, কোনো সূত জাতের কেউ অস্ত্রচালনার অধিকার রাখতোনা।
অধিরথ সূত বলে রাধেয় সূতপুত্র বলে পরিচিত। তারা কেবল ঘোড়ার সহিস বা ঘোড়ার গাড়ি চালনায় সীমাবদ্ধ।
কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র আর মাতা কুন্তির রক্ত বলে কথা, তার দ্যুতি যাবে কোথায়!
তাই সে, সমাজের এই ঠুনকো জাতভেদ মেনে নিতে পারেনা এবং গোপনে যতটুকু সম্ভব চর্চা করতে থাকলো।
এর মাঝে নির্জনবাস থেকে পঞ্চপান্ডব, কুন্তি সমেত ফিরে এলো সিংহাসনের দাবীতে।
রাধেয় শুনলো অর্জুন নামে নাকি এক পান্ডব আছে যে দুর্দান্ত তীরন্দাজ, যাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য।
তখনই সিদ্ধান্ত নিলো অর্জুনকে হারিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে শিষ্যত্ব চাইবে। তখন নিশ্চয় গুরু দ্রোণ রাধেয়'র গরিমা দেখে খুশি হয়ে ওকে গ্রহণ করবে।
কিন্তু তা হলোনা, বরং উল্টো সবকিছু দেখেও দ্রোণাচার্যও সেই একঘেয়ে জাতভেদ তুলে তাকে নিরস্ত্র হতে উপদেশ দেয় এবং সূতপুত্র হবার দরুন ধিক্কার করে।
কি হস্তিনাপুরের রাজসভায়, কি পাঞ্চাল রাজ্যের স্বয়ম্বর সভায়, জীবনের সবক্ষেত্রেই সূতপুত্র বলে তাকে সমাজ, সংসার আক অবরুদ্ধ শেকল পরাতে চাইলেই-
কি এক অজ্ঞাত অভিমানে, গুমোট আক্রোশে অজান্তেই কর্ণ সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে।
এবং আদপেই আস্তে আস্তে সে আক্রোশ প্রশমিত হয়ে আসে।
কথিত আছে কর্ণ যখন প্রচন্ড রেগে যেতো অদ্ভুতভাবে সূর্যের আঁচও নাকি বেড়ে যেতো!
দ্রোণাচার্যের সে প্রত্যাখ্যান ছিল কর্ণের জন্য কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার মত।
আর ওরকম ভঙ্গুর মুহূর্তে আর্যাবর্তের স্বয়ং যুবরাজ হিসাবে, দুর্যোধনের কর্ণের স্বপক্ষ সমর্থনে এগিয়ে আসাটা ছিলো বোধহয়, দূর্যোধনের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ওখান থেকেই আমাদের রাধেয় হয়ে ওঠতে থাকে কর্ণ।
কর্ণ আলাপন
মহাভারতের সমগ্র চিত্রপট আমার অনেক পছন্দের আলাপের বিষয়বস্তু হলেও, বলতে পারিনা তেমন কোনো চরিত্র আছে যাকে "প্রিয়" বলে আখ্যায়িত করা যায়।
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের চরিত্র আমার বেশ বিরক্তই লাগে, অর্জুনের মহিমা'র তুলনায় তার বিসর্জন ভীষণ অযোগ্য, দুর্যোধন বোকা গাধা। কুন্তি মহিমান্বিত কিন্তু একঘেয়ে, দ্রৌপদী বিয়ের পরে সব স্বভাবজাত, নিরেট রমণী হয়ে যায়!
যদিও, কৃষ্ণের প্রেমে পড়েছি বটে, সে অন্য হিসেব! মানে কৃষ্ণে প্রেম না করবার ক্ষমতা কার আছে!
তবে এখন আলাদাভাবে চরিত্র বিশ্লেষণ পড়ে, প্রিয় চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন কর্ণ আর ভীষণ কৌতুহলের জায়গা হয়েছে শকুনি!
নিয়মতান্ত্রিক, একগুঁয়ে সমাজ সংসারের অবরুদ্ধ, গোঁড়ামি'র কারণে আমৃত্যু নিজেকে প্রমাণ করতে থাকার জন্যই কিনা কে জানে, কেনো যেনো খুব কাছের মনে হয় কর্ণকে।
আমি আক্ষরিকার্থেই চোখভরা পানি নিয়ে হাহা করে হেসেছিলাম যখন মাতৃত্বের দাবী নিয়ে কুন্তি কর্ণর কাছে এসেছিল।
কিন্তু কর্ণ আপ্লুত হলেও দৃঢ় কণ্ঠে সে কুন্তি'র স্বার্থপর প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যেন অনুক্ত স্বরে বলেছিল-
আমি কৌন্তেয় নই, রাধেয়।
রাধেয় অজেয় ছিল, শেষ মুহূর্ত অব্দি।
অর্জুনই, কর্ণকে বধ করলেও, সম্মুখ সমরে, সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই হলে অর্জুন যে কখনোই কর্ণকে পরাজিত করতে পারতো না এ সত্য অবিসংবাদিত।
যেমনটা মহাভারত কর্ণের মৃত্যুর আখ্যান রচিত করে গেছে, পাশাপাশি সে যে আসলেই অপরাজেয়, সেই অব্যক্ত সত্য'র ছাপও রেখে গেছে।
Hi @fahmidamou, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @linco!
Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.
JOIN US ON