আমরা সবাই একই পথের পথিক, তাই না?

in BDCommunity4 years ago

tea-lights-3612508_1280.jpg

চাঁদের বুড়ি মন দিয়ে চড়কা কেটে যাচ্ছে। সে বসে আছে এক বিশাল গাছের নিচে। গাছের প্রতিটা পাতায় পৃথিবীর জীবিত মানুষদের নাম লেখা আছে। যে পাতাটা পড়ে যাবে, পৃথিবীতে সেই মানুষটাও মরে যাবে। এত এত পাতা যে প্রতিনিয়ত পড়ে যাচ্ছে, চাঁদের বুড়ির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে আপন মনে চরকা কেটেই যাচ্ছে, আর ওদিকে প্রতিদিন গাছ থেকে কোনো না কোনো পাতা পড়েই যাচ্ছে।

গতকাল রাতেও গাছ থেকে একটা পাতা মরে পড়ে গিয়েছে। সেটা আমার বড় চাচীর পাতা। মধ্যরাতে হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন তিনি। খবর পেয়ে ভোর রাতেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। পুরো রাস্তা জুড়ে অদ্ভুত এক বিষন্নতা কাজ করছিল মনের ভেতর। কিছুদিন আগে যখন গ্রামে গিয়েছিলাম, তখন নিজের পাশে বসিয়ে রেখে ছোট মাছ দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বেশি দিন হয় নি, এইতো কিছুদিন আগের কথা মাত্র।

আমার দাদী যখন মারা যান, তখন আমার আব্বুর বয়স ৬-৭ বছর ছিল সম্ভবত। সদ্য মাকে হারানো আমার আব্বু আর অন্য ছোট চাচাদের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। নিজের সন্তানদের পাশাপাশি তিনি তার দেবরদেরও সন্তানের মতো পেলে পুষে বড় করেছিলেন। আব্বু মারা গিয়েছেন আজ প্রায় তিন বছর হলো। এই তিন বছরে যতবার চাচীর কাছে গিয়েছি, ততবারই তিনি আব্বুর ছোটবেলার গল্পগুলো আমাদের সাথে কান্না করতে করতে বলতেন। আজ তো তিনি নিজেই চলে গেলেন। সেই গল্পগুলো এখন আমি কার কাছ থেকে শুনবো?

গ্রামে পৌছতে পৌছতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ির একটু সামনেই কবরস্থান। বাড়িতে যাবার সময় কবরস্থানের উপর দিয়েই যেতে হয়। যাবার সময় দেখি বড় চাচা কোদাল, শাবল নিয়ে কবরস্থানের পাশেই চুপচাপ বসে আছেন। গত ২০-২৫ বছরে আমাদের বাড়িতে যারা মারা গিয়েছেন, তিনি প্রায় সবার কবর নিজে খুঁড়েছেন। প্রায় এক থেকে দেড়শো জন তো হবেই। আজকে তিনি তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কবর বানানোর জন্য বসে আছেন। যদিও সবাই না করছিল, কিন্তু বড় চাচা তার জেদ ধরেই বসে ছিলেন।

চাচার সাথে বসে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, কিন্তু সাহস হয় নি। একটু হেঁটে বাড়ি যাবার পর দেখি পুরো বাড়ি থমথম অবস্থায় আছে। একটু দূরে কান্নাকাটির শব্দ। অবশ্য এমন পরিস্থিতি বহুবার দেখেছি। এই ছোট্ট জীবনে কম তো আর দেখি নি। একটার পর একটা মৃত্যু দেখেছি খুব কাছ থেকে। আমরা সবাই তো একই পথের যাত্রী। এই পৃথিবীতে কয়েকটা দিন শুধু মুসাফির হিসেবেই এসেছি।

বাড়িতে ঢুকি নি আমি। বাড়ির পেছনের পুকুর পারে চুপচাপ বসে ছিলাম অনেকটা সময়। কান্না আসছিল খুব। এই পুকুর ঘাটের প্রতিটা কোনায় কোনায় অসংখ্য স্মৃতি মিশে আছে। ছোটবেলায় এখানে আমরা কত গোসল করেছি, ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতরে বেরিয়েছি। আমার আব্বুও হয়তো ছোটবেলায় এখানে আমার মতো করেই গোসল করেছিল, সাঁতরে বেড়িয়েছিল। এরপর বড় চাচীর ঝাড়ি খেয়ে একটা সময় পর উঠে বাসায় চলে যেত। আজকে উনারা আর কেউ নেই এখানে।

আমার স্মৃতি শক্তি খুব দূর্বল। পুরানো কোনো স্মৃতিই পুরোপুরি ভাবে মনে রাখতে পারি না। তার উপর আজকের এই দিনে সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছিল। স্মৃতির আয়নায় বারবার চাচীর সাথে আমার স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোনো কিছুই মাথায় আসছিল না। শুধু বুকে ভেঙ্গে কান্না জমে আসছিল চোখে।

সবকিছু সামলে নিয়ে চাচীর সাথে শেষ দেখাটাও করে আসলাম। বয়সের ভারে অনেকটা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিছানায় ছোট্ট দেহটা চুপচাপ শুয়ে ছিল। মুখের ভাঁজে ভাঁজে সময়ের ছাপ স্পষ্ট। এই শরীরটা কত কাল, সময়, স্মৃতির স্বাক্ষী যে বহন করে চলছিল, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

জীবন নিয়ে আমাদের কতো আশা আকাঙখা। অথচ একটা সময় পর আমাদের কিছুই থাকে না। আচ্ছা, মরে যাবার পর মানুষ কি আসলেই হারিয়ে যায়? হারাবে কেন? আমার সব প্রিয় মানুষগুলো তো আমার বাড়ির সামনের ছোট্ট কবরস্থানে শুয়ে আছে। আমার যখন মন খারাপ থাকে, তখন মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে বসে থাকি। কথা বলার চেষ্টা করি। একটা সময় পর তো আমার স্থানটা এখানেই হবে। শত কিংবা হাজার বছর ধরে এখানেই শুয়ে থাকতে হবে...

মৃত্যুকে তো ভয় পাই না, পাওয়া উচিতও না। মৃত্যু হলো সবচেয়ে কঠিন সত্য। জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যু তো অবশ্যই হবে। ছোট এই দুনিয়ার মোহ যতটুকু সম্ভব কাটানো যায়, ততই ভালো। মায়া খুব বাজে জিনিস। আবার এই মায়া ছাড়াও পৃথিবীতে টিকে থাকা মুশকিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। দিন শেষ প্রকৃতির কাছে আমরা মানুষেরা খুব অসহায়...

Sort:  

গত ২০-২৫ বছরে আমাদের বাড়িতে যারা মারা গিয়েছেন, তিনি প্রায় সবার কবর নিজে খুঁড়েছেন। প্রায় এক থেকে দেড়শো জন তো হবেই। আজকে তিনি তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কবর বানানোর জন্য বসে আছেন।

হৃদয় বিদারক।

মহান আল্লাহ্ চাচিকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন, আমিন।।

আমিন