উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা এক কিশোরী, নাম তার নীলিমা। সে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত তখন তার বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ে এবং তার সাথে সামান্য কিডনির সমস্যাও ধরা পড়ে। ডাক্তার উনাকে নিয়মিত সেবনের জন্য কিছু ওষুধ লিখে দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কিছু টিপসও বলেছিল। কিন্তু তিনি ডাক্তারের কথাগুলোকে গুরুত্বের সাথে নেন নি। নিয়মিত ওষুধগুলো সেবন করতেন না এবং ডাক্তারের দেওয়া স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক টিপসগুলো সঠিকভাবে পালন করতেন না, যার ফলে কয়েকমাসের মধ্যে তার কিডনির সমস্যাটি খারাপের দিকে মোড় নিল। মাস ছয়েক পর ডাক্তার বলল,"উনার দুটি কিডনিই প্রায় বিকল হয়ে গেছে। প্রতি সাপ্তাহে এক বার করে উনাকে ডায়ালাইসিস করাতে হবে। এটি শুনার পর তার বাবা মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে গেল। কারন উনার দুই মেয়ে বড় মেয়ের নাম নীলিমা আর ছোট মেয়ের নাম নুপুর। তাদেরকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সে মারা গেলে ত তার মেয়েরা এতিম হয়ে যাবে। এই চিন্তা করে প্রতি রাতে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতেন তার বলতেন,"আল্লাহ! তুমি আমার মেয়েদের এতিম কইরো না!"
সে যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠত তখন তার বাবার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। নীলিমার মা হলো একজন সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। স্কুলের কাজে সকালেই তাকে বের হয়ে যেতে হতো, আর নীলিমার স্কুল দুপুরের সিফটে হওয়া সে তার বাবার সেবা করে স্কুলে যেতে হত। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে তার বাবা বিভিন্ন কাজে দরকার লাগলে তার মেয়ে নীলিমাকে ডাকত। এসব দেখে তার মা খুবই বিরক্ত হত এবং বলল," মেয়েটার পরিক্ষার সামনে, এমন করতে থাকলে, মনে হয় মেয়েটা এবার ফেল করবে!"
প্রতি উত্তরে তার বাবা বলল,"আমার মেয়ে ফেল করবে না, ইনশায়াল্লাহ ভাল রেজাল্টই করবে।"
শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে উনার। ডাক্তার বলল, উনাকে সাপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করাতে হবে। এর একমাস পর ডাক্তার বলল," উনার শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ এখন থেকে উনাকে দুইদিন পর পর ডায়ালাইসিস করাতে হবে। এমতাবস্থায় দুদিন পর হসপিটালে ডায়ালাইসিস করারত অবস্থা উনার মৃত্যু ঘটে।
যখন তার বাবা মারা যায়, তখন নীলিমা স্কুলে ক্লাস করতেছিল, ক্লাস চলাকালীন অবস্থায় ক্লাসে তার পাশের বাসার এক আন্টি এসে তাকে তার বাবার শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ বলে তাকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় এসে দেখে এম্বুলেন্স থেকে তার বাবার লাশ নামানো হচ্ছে, তার মা কান্না করছে! এসব দৃশ্য দেখে তার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল।
সে গাড়িতে করে তার পরিবারের সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেল। তার বাবাকে যখন কবর দেয়ার জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সবার সাথে তার নিজের যেতে অনেক ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু মেয়ে হওয়ার কারনে সে যেতে পারে নি। সেই মুহুর্তে তার বাবার সাথে কাটানো সময়গুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এবং সে প্রচন্ড আবেগী হয়ে পড়ল।
নীলিমা তার বাবাকে অনেক ভালোবাসত। আগে যখন অবসর সময় পেত, তারা বাবা-মেয়ে গল্প-আড্ডা শুরু করে দিত। অবসর সময় সে তার বাবার সাথে কাটাতে বেশি পছন্দ করত। আগে যখন সন্ধ্যার পর নীলিমা পড়ার টেবিলে পড়তে বসত, মাঝে মাঝে তার বাবা তার রুমের দরজায় দাড়িয়ে দেখত মেয়ে পড়তেছে কিনা। মাঝে মাঝে পড়া শেষে যখন তার চোখ দরজায় পড়ত হঠাৎ সে তার বাবাকে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠত।
বাবার কবর দেয়ার এক সাপ্তাহ পর সে তার মা আর ছোট বোন নুপুরকে নিয়ে বাসা চলে আসে। বাসায় এসে সে তার বাবার শূণ্যতা অনেক অনুভব করতে লাগল। যে বিছানায় তার অসুস্থ বাবা সারাদিন পড়ে থাকত, সেই বিছানা দেখে সে প্রচন্ড আবেগী হয়ে গেল। সন্ধার পর পড়তে বসলে, সে অনুভব করত তার বাবা তার রুমের দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে, হঠাৎ দরজায় চোখ পড়লে বাবাকে আর দেখত না। তারপর তার মনে হত আর বাবা ত আর নেই। এইসব স্মৃতিগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং সে অনেক আবেগী হয়ে পড়ে...! এসব কিছু স্মৃতির মাঝে তার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে অনুভব করে।
বাসায় এসে কয়েক মাস পড়ার পরে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরিক্ষা দিল এবং তার বাবার কথাই সত্যি হল। আর বাবার দোয়ায়, সে জিপিএ ৫ পেল।