প্রথম ঈদ

in BDCommunity3 years ago

আমরা তিন বোন এক ভাই।আমি বোনদের মধ্যে ছোট।আর ভাই আমার ছোট।ওর নাম আশরাফুল ইসলাম শাওন।আমার বয়স যখন দশ বছর তখন শাওনের জন্ম।শাওনের জন্ম রাত বারোটার সময়।আব্বার আজানের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে।আনন্দের ফোয়ারা বইতেছিলো সবার মনে।আমি চৌকিতে ঘুমাচ্ছিলাম আর শাওনের জন্ম মেঝেতে,মাটিতে পেতে রাখা বিছানায়।

আমি আবার ঘুমিয়ে যায়,খুব ভোরে আম্মা আমাকে ডেকে দেয় মামার বাড়িতে খবর দেওয়ার জন্য তখনতো আর মোবাইল ফোন ছিলো না।আমি ঘুম থেকে উঠে আমার এক ভাইপোকে নিয়ে মামার বাড়িতে যাচ্ছি,সারা রাস্তায় একটাই চিন্তা গিয়ে কিভাবে বলবো আমার ভাই হয়েছে!বিভিন্ন পরিকল্পনা করছি।মামার বাড়ি যাওয়ার পথে একটা মক্তব আছে,সেখানে যাওয়ার পর আমাদের এক চাচাতো মামা আমাকে এতো সকাল সকাল দেখে জিজ্ঞেস করলেন,"কিরে রুবি তুই এতো সকাল সকাল,তোর মা ভালো আছেতো?"
আমি বললাম,হ্যাঁ ভালো আছে,আমাদের ভাই হয়েছে।
এই একবারি বলেছিলাম,আমার আর কাউকে বলতে হয়নি।তিনি আনন্দে দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছেন আর বলছেন,আয়শুর ছেলে হয়েছে,আয়শুর ছেলে হয়েছে।আমার আম্মার নাম আয়েশা,ওনার ভাইয়েরা আদর করে ডাকেন আয়শু।

এরপর মামার বাড়ি থেকে নাস্তা খেয়ে ছোটো মামার সাথে বাড়িতে চলে আসলাম।বাড়িতে এসে চৌকিতে শুয়ে রাখা ছোট্র শাওনকে দেখলাম। নিচের ঠোঁটটা এতো চিকন যে শুধু একটা ঠোঁট দেখা যাচ্ছিল।শুধু এতটুকু মনে আছে আমার।

আম্মা বলছিলো ওকে খাওয়াতে হবে।আমি বললাম,আমি খাওয়াবো।আম্মা বললো,তুই পারবি?আমি বললাম,হ্যাঁ পারবো।ধনিয়া ভিজানো পানি চামচে নিয়ে ছোট এক টুকরো নরম সাদা কাপড় দিয়ে ওর মুখে অল্প অল্প দিচ্ছি,ও একটু একটু করে খাচ্ছে।

আমার মেজো আপা তখন মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতো,আর বড় আপা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী পড়ালেখার খুব চাপ।আম্মা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতো।তাই শাওনেকে বেশিরভাগ সময় আমার সাথে থাকতে হতো।আমার একটা ছাগল ছিলো সেই ছাগল থেকে দুধ দোহন করে,পানি মিশিয়ে পাতলা করে ওকে খাওয়াতাম।কারণ সবাই বলতো ছাগলের দুধ খাওয়ানো ভালো।কিন্তু পাতলা করে খাওয়াতে হবে।ছাগলের দুধে এক ধরনের গন্ধ আছে যা আমার একদম সহ্য হয় না,কিন্তু ও যখন মজা করে খেতো তখন আমার এসব গন্ধের কথা মনেই থাকতো না।

ছোট বেলায় ওর সর্দি লেগেই থাকতো,রাতের বেলায় ওর খুব কষ্ট হতো।বড়আপা তখন আমপাতা এনে এতে সরিষার তেল গরম করে সেই তেল ওর মাথা,নাক,হাতের তলায় আর পায়ের তলায় দিতেই থাকতো।
আমার মেজো আপা আমার মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করলেও আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেতো।আমি তখন শাওনকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করতাম রাস্তের পাশে মেজোআপার জন্য,সারাদিন শাওন কি কি পাকনামি করেছে তাই বলার জন্য।

শাওনের যখন বয়স চারমাস তখন ওকে উপরে উঠিয়ে ওর পেট আমার মাথায় রাখলে ও জোরে জোরে হাসতো।একদিন সকালে সেটা মেজো আপাকে দেখানোর জন্য রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিলাম।মেজো আপা আসার পর দেখলাম তার মাথায় একটা নতুন প্রজাপতি।তখন
স্টিলের একধরনের প্রজাপতি ক্লিপ ছিলো।যার পাখাগুলো স্প্রিং দিয়ে লাগানো থাকতো।এটা চুলে দিয়ে হাঁটলে মনে হতো প্রজাপতি উড়ছে।মামা ঐদিন রাতে এটা মেজো আপাকে দিয়েছেন,আমি বললাম বাহ্ সুন্দর প্রজাপতি।এটা বলার সাথে সাথেই মেজো আপা প্রজাপতিটা খুলে আমার মাথার সামনের দিকের চুলে লাগিয়ে দিলো।আমি মেজো আপাকে ছোট আপা বলে ডাকি।আসলে ডাকটা ছোটো আপা হলেও আমি ডাকি ছোটো,আর ''তুই'' সম্বোধন করি।

আমি বললাম, দেখ ছোটো শাওনকে মাথায় নিলে কেমন করে হাসে।বলার সাথে সাথেই মাথায় উঠিয়ে ধরলাম আর শাওন চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।'ছোটো' বই ফেলে শাওনকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিল।আমার মাথায় লাগানো প্রজাপতিতে লেগে ওর পেটের দুই ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা কেটে গেছে।আম্মা আমাকে সেদিন খুব বকেছিলো,তাতে আমার কষ্ট হয়নি।তবে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব,কারণ শাওন কষ্ট পেয়েছিলো।

শাওনের যখন পাঁচ মাস বয়স তখন রমজানের রোজা শুরু হলো।তখন আমাদের বাজারে দোকান ছিলো।আমি প্রতিদিন দোকানে যেতাম আর আব্বাকে বলতাম এটা ছেলের প্রথম ঈদ কেনাকেটা করবো।আব্বা বলতো ঈদ এখনও অনেক দেরি কিনে নিস পরে।আমার কি আর তর সয়,আমার পাগলামীপনা দেখে আব্বা বললো যা কিনে ফেল কি কিনবি।

আব্বার দোকানের দুই দোকান পর ছোট বাচ্চাদের কাপড়-জুতার দোকান,আব্বা ওখানে নিয়ে গেলেন।আমি আমার পছন্দমতো একটা গেঞ্জি-প্যান্টের সেট কিনলাম।কিন্তু বাঁধ সাধল জুতা,কারণ ও যে হাঁটতে পারেনা এখনও।তাই আব্বা জুতা কিনতে নিষেধ করে দিয়েছেন।ঐ দোকানে একটা চকলেট কালারের চামড়ার জুতা একটু বড় ওর পায়ে হবে না।না হলেই বা কি ওতো এখনও হাঁটতেই পারে না,দামও একটু বেশি।তাই আব্বা কিনে দেয়নি।বাড়িতে এসে জুতার জন্য সেই কান্নাকাটি করলাম।পরেরদিন আব্বা বাধ্য হয়ে জুতাগুলো কিনে দিয়েছিলো।পরে আবার মামার বাড়ি থেকেও জুতা আর ড্রেস পাঠিয়েছিল মামা।

ঈদের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম।উঠেই পাগলামি শুরু করলাম ওকে নতুন জামা পড়াবো।বড় আপা আটটার দিকে ওকে গোসল করিয়ে,নতুন জামা পড়িয়ে তৈরি করে দিলো।আমি প্রথমে ওকে ঈদের নামাজ পড়ানো দেখিয়ে নিয়ে আসলাম।তারপর ঈদগাহের পাশের মেলায় নিয়ে গেলাম।

আমাদের এখানে ঈদগাহের পাশে ঈদের দিন মেলা বসে,সকাল পাঁচটা থেকে দুপুর পর্যন্ত।ওকে কোলে নিয়ে মেলা থেকে ওর জন্য মাটির গরু,ব্যাংক,স্টিলের পিস্তল আর একটা কাগজের ফুল কিনলাম।বড় আপার জন্য একটা আয়না কিনলাম।"ডালভুরি",আর একধরনের মিষ্টি কিনলাম।এতো জিনিসসহ আমি যখন ওকে নিয়ে আসতে পারছিলাম না তখন আমি আমার কোলে থাকা শাওনকে বললাম,ভাইয়া তুমি আয়নাটা একটু ধরবে।ও ধরলো।আমি ওকে কাঁধে শুইয়ে, হাতে সবজিনিস নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িতে আসতেছি তখন ও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু আয়নাটা বাড়ি পর্যন্ত ধরে রেখেছে,ছাড়েনি।বাড়িতে আসার পর দেখি ওর হাতটা লাল হয়ে গিয়েছে।সেদিনও আম্মা আমাকে বকেছিল আর ও সন্ধ্যা পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল।এভাবেই শেষ হয়ে গেলো আমাদের গোলগাল ছোট্ট বাবুসোনার প্রথম ঈদ।

সমাপ্ত

(আমার জন্ম আর প্রথম ঈদ আমার বোনের জবানিতে...)

png-clipart-cartoon-cute-baby-baby-little-baby.png

Sort:  

Choto bacchader 6 mash er age onno khabar khawano jay?

আগেরদিনের গ্রামের মানুষরা খাওয়াইতো,যদিও সেটা উচিত না।