দুরন্ত শৈশব

in BDCommunity3 years ago

IMG_20210322_163718_1.jpg

দুই বিঘা জমির উপর আমাদের ছোটো বাড়ি।বাঁশ ঝাড়,পুকুর,বিভিন্ন ধরনের গাছ,আম্মার ছোটো সবজি বাগান এ নিয়ে আমাদের বাড়ি।আম,জাম,কাঁঠাল,কলা,লিচু,বেল,আমড়া,জাম্বুরা,খেজুর,তেঁতুল সহ প্রায় সবধরনের ফল গাছ ছিলো আমাদের বাড়িতে।আর এ সবকিছুর সাথে ছিলো আমার গভীর মিতালী।আম গাছের আম আঁটি বাঁধার আগে থেকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আম গাছের ডালেডালে ছিলো আমার অবাধ বিচরণ।

আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে সীমানার শেষপ্রান্তে একটা বড় আম গাছ।এই গাছটাকে আমরা বলি "আব্বার গাছ"। কেনো বলি জানিনা,আব্বা বেঁচে থাকতে কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি।গাছটি যেমন মোটা এবং বড়, আমগুলোও তেমন বড় বড় হয়।এই গাছের প্রতিটা ডালের গোঁড়া রোগাক্রান্ত।গ্রামের ভাষায় একে " মাঞ্চরা" রোগ বলে।এ রোগের শুদ্ধ নাম আমার জানা নেই।এই মাঞ্চরার ভিতর থাকে একধরনের বিষাক্ত পিঁপড়া।হাতের এক আঙুলে কামড় দিলে ব্যাথায় সারা হাত ফুলে যেতো।যেদিন কামড় দিতো সেদিন কোনো কিছু ধরতে পারতাম না।এই পিঁপড়া যখন কামড়ে দিতো তখন বলতাম এই গাছে আর কোনোদিন উঠবো না।কিন্তু পরের দিন ব্যাথা চলে গেলে আবার উঠতাম।

আমাদের পুকুরপাড়ে বড় আরেকটা আমগাছ ছিলো।এই গাছটাকে আমরা বলতাম,রনি আমগাছ।এই গাছের আমে বিশেষ একধরনের গন্ধ,এই গন্ধযুক্ত আমকে রনি আম বলে তাই এই নাম।এখন অবশ্য এই আমগাছটা নেই।এই আমগাছের কান্ড থেকে শাখা দুইদিকে ভাগ হয়ে ছিলো।একটা শাখা পুকুরের দিকে,অন্যটা ডাঙার দিকে,বেশিরভাগ আম থাকতো পুকুরের উপর।আম পুকুরে পড়লে হারিয়ে যেতো।তাই বিশেষ ধরনের বক্সওয়ালা বড় লাঠি দিয়ে আম পাড়তে হতো।

একদিন আমি আম পাড়তে এই গাছে উঠলাম আম্মা ব্যাগ আনতে বাড়িতে গেলো।আমি গাছে উঠে দেখলাম পুকুরের উপরে যে শাখা সেটায় বড় এক গুইসাপ শুয়ে আছে।আমি তাড়াতাড়ি বিপরীত পাশের শাখায় চলে গেলাম।গুইসাপ আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে,আমি গুইসাপকে দেখে ভয় পাচ্ছি।গুইসাপের ঘাড়ে কাঁটার মতো কিছু অংশ থাকে।গুইসাপ ঘাড়ের সেই কাঁটাগুলো খাড়া করে আমার দিকে তাকিয়ে,লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে গড়গড় আওয়াজ করতে লাগলো।আমিতো ভয়ে সেই চিৎকার,আম্মা,আম্মা।আম্মা দৌড়ে এসে দেখে গুইসাপ,আম্মা বলল গুইসাপ কামড় দেয় না,হাত ছেড়ো না,হাত ছাড়লে পরে যাবে।গাছে না উঠে আম পাড়ার জন্য আম্মা একধরনের লম্বা চিকন বাঁশ ব্যবহার করেন এটাকে আমরা বলি কোঁটা।আম্মা কোঁটা এনে গুইসাপকে গুঁতো দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়।গুইসাপ তখন দৌড়ে পালায়,আর আমি ব্যাগ ভরে আম নিয়ে নেমে আসলাম।

আমাদের ঘরের পিছনে বাঁশঝাড়ের কাছে আরেকটা আম গাছ।এই গাছটা অনেক বেশি উঁচু হওয়ায় প্রতিদিন উঠা সম্ভব নয়।আম পেকে যাওয়ার পর একদিন দড়ি আর ব্যাগ নিয়ে উঠতাম।আম ব্যাগে ভরে দড়িতে বেঁধে আমি নিচে পাঠাতাম আম্মা কিংবা ছোটো আম রেখে ব্যাগ বেঁধে দিতো এভাবে একদিনে সব আম পাড়তাম।গাছটি বাঁশঝাড়ের ভিতরে হওয়াই অনেক বাঁশ গাছের উপরে পড়ে থাকে।একদিন আম পাড়তে গাছে উঠে দেখি গাছে ছোট একটা "বলার বাসা"।

বলা ছোট একধরনের বিষাক্ত মৌপোকা,মৌমাছির মতো,কামড়ে দিলে এক সপ্তাহ লাগে সুস্থ হতে।তবে বাসায় মাত্র পাঁচটা বলা ছিলো আর নিচের দিকে ছিলো,তাই আম পাড়ার সময় কোনো সমস্যা হয়নি।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আম পাড়া শেষ হলে,নিচে নামবো কোন দিক দিয়ে,এইদিক দিয়ে নামলে যদি বলা কামড়ে দেয়।তাই ভাবলাম অন্য দিক দিয়ে যেহেতু বাঁশ আছে,বাঁশ দিয়ে নামা যাবে।বাঁশ অনেকটা মইয়ের মতো একপা একপা করে নিচে নামছি।যেদিককে বিকল্প পথ ভেবে আমি নিচে নামছি সেখানে ছিলো আরো অনেক বড় একটি বলার বাসা,যাতে শতশত বলা।আমি না দেখে মধ্যখানে দিয়েছি পা,সঙ্গে সঙ্গে বলা আমাকে ঘিরে ধরলো,আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার,ছোটো সেদিন সেই বলার ভিতর উঠে নিজে বলার কামড় খেয়ে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো।বলা সেদিন আমার শরীরে এতো হুল ফুটিয়ে ছিলো যে এক সপ্তাহর মতো জ্বর ছিলো,অবশ্য ছোটোরও একি অবস্থা হয়েছিলো।আমি ছোটোকে দেখে বুঝতে পারি বড়বোন আর মায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

আমাদের বাড়ির পশ্চিমপাশের কোণায় একটি জাম্বুরা গাছ।গাছটির কান্ড দুই ফুট উঁচু,শাখা প্রশাখা গুলোও তেমন উঁচু নয়।এর উপরের দিকে একটা ডাল সাইকেলের ক্যারিয়ারের মতো,আবার তার উপর দিয়ে আরেকটা ডাল সোজা চলে গেছে।আমি ঐখানে উঠে ক্যারিয়ারের মতো জায়গায় শুয়ে উপরের দিকে ডালটায় পা দিয়ে ঝাপটিয়ে ধরে রাখতাম।দুপুরবেলায় এটাই ছিলো আমার খেলার জায়গা।এখানে শুয়ে একা একা কথা বলতাম,পাতার বাঁশি বাজাতাম,পাতা দিয়ে পাখা বানিয়ে উড়াতাম আরও কতকি।আর বিকালে ছিলো এটা আমার পড়ার আসন,এখানে শুয়ে বই পড়তাম।

এখন আমি শহরের বাসিন্দা।ইট পাথরের এই শহরে বাস করে আমার রক্ত মাংসের শরীর আর মনটা থাকে আমার সোনার গাঁয়ের ছোট্ট বাড়ির সবুজ-শ্যামল আঙিনায়।একাকিত্ব আমাকে কখনও গ্রাস করে না,একা থাকলে আমি ফিরে যায় দুরন্ত শৈশবে।যেখানে আমি ছিলাম রাজাধিরাজ,ফুল,পাখি আর মাছেরা ছিলো আমার রাজ্য।

সমাপ্ত

IMG_20210424_160248.jpg

Sort:  

Congratulations @shaonashraf! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You published more than 100 posts.
Your next target is to reach 150 posts.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP