বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর কিছু স্থাপত্যশৈলির নাম বলতে গেলে "বাংলাদেশ সংসদ ভবন" এর নাম প্রথম কাতারে চলে আসবে।সংসদ ভবনের ভিতরে সংসদ সদস্যরা কতোটা সুন্দরভাবে এটাকে পরিচালনা করছে এবং বিশ্বের অন্য দেশের সাথে তাল মিলাতে পারছে কিনা সেটা ভিন্ন কথা,কিন্তু বাংলাদেশ সংসদ ভবন তার সৌন্দর্য দিয়ে ঠিকই অন্য দেশের সাথে তাল মিলাতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
সংসদ ভবনকে ছবিতে তো সেই ছোট থেকে দেখে আসছি।ছোট সময় সংসদ ভবনকে সবচেয়ে বেশি দেখেছি বিটিভিতে,সংবাদে বা যখন সংসদের অধিবেশন চলে তখন।আর তখন সরকারী ক্যালেন্ডারসহ বিভিন্ন ক্যালেন্ডারে সংসদ ভবনের ছবি দেখতাম।সাধারণ জ্ঞানের বই মানেই প্রথম দিকে এটা থাকবে যে সংসদ ভবনের স্থপতি কে?লুই আই কান।পরবর্তীতে একটা প্রতিবেদনে পড়েছিলাম,তার পারিশ্রমিক নাকি আজও পুরোটা দেওয়া হয়নি।
যাইহোক এসব কারণে, সংসদ ভবন ছোট থেকেই অতিপরিচিত একটি স্থাপনা।
তারপর স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে ঢাকা আসার পর অনেকবার বাসে করে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়া হয়েছে,আর তখন সংসদ ভবনকে দেখা হয়েছে।কিন্তু চলন্ত বাসে থেকেতো আর কোনো কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় না।তাই প্রথম কোন দিন সংসদ ভবনকে দেখেছি সে কথা স্মরণ নেই।তবে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মামাতো ভাই এর বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিলো,সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে রাস্তার ওপারের কনভেনশন সেন্টারে।কিন্তু তখন রাত থাকায়,সংসদ ভবনকে দেখা হয়নি ভালোভাবে।
এরপর আরও হাজারবার সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু এর সৌন্দর্য উপভোগ করার ভাগ্য হয়ে উঠেনি।আসাদগেটে অনেকবার এক বাস থেকে নেমে আরেক বাসে উঠেছি,কিন্তু তবু সংসদ ভবনের দিকে ধীরস্থিরভাবে তাকিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি।
যাইহোক,গত সপ্তাহের মতো এই সপ্তাহেও আমার সহপাঠী শরীফ পরিকল্পনা করেছে সংসদভবন ঘুরতে যাবে।এর আগে আরও অনেকবার আমাদের পরিকল্পনা হয়েছিলো,সংসদ ভবন ঘুরতে যাওয়ার।কিন্তু একেকবার একেক কারণে হয়ে উঠে নি।তাই সংসদ ভবন ঘুরতে যাওয়া আমাদের জন্য একটা "মিথ" হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।কিন্তু আজ বিকালে আমার সহপাঠী শরীফ আর হাসিব প্রস্তুত হয়ে এসে বলছে,তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নে,সংসদ ভবন যাবো।আমি বললাম,বলিস কি!সত্যিই যাবি!
প্রস্তুত হয়ে বের হয়ে,একটা রিক্সা নিলাম সংসদ ভবন যাওয়ার জন্য।আমার অবশ্য ইচ্ছে ছিলো অন্য যানবাহনে যাওয়ার সেগুলো সাশ্রয়ী কিনা!কিন্তু হাসিব বললো,রিক্সা করে ঢাকা শহর ঘুরার মজা আলাদা।তাই রিক্সায় উঠলাম।আর এক রিক্সায় তিনজন মানেই,আমার আর সিটে বসার সুযোগ নেই,সিটের উপরে যে শক্ত দেয়ালের মতো থাকে,সেটাই আমার বসার স্থান।যাইহোক,রিক্সায় বসে হাওয়া খেতে খেতে সংসদ ভবন পৌঁছালাম।
অবশ্য হাওয়া আমি বেশি খেতে পারিনি,রিক্সার ঐ অংশটা শক্ত কিনা!
সংসদ ভবনের সামনে যেতেই যখন স্থির হয়ে প্রথমবারের মতো সংসতভবনের দিকে তাকালাম,সত্যিই সংসদ ভবনকে ছবির মতো মনে হচ্ছিল।অবশ্য হতাশ হলাম এটা দেখে যে,এর লোহার তৈরি সীমানা প্রাচীরে ঝুলানো আছে যে,নিরাপত্তার স্বার্থে সংসদ ভবনে সাধারণ মানুষের প্রবেশ স্থায়ীভাবে নিষেধ।ভিতরের মাঠটাতে যেতে পারলে আরও বেশি ভালো লাগতো।চারপাশে বিরাট আকৃতির মাঠের মতো,যা কিনা সবুজ ঘাস দিয়ে আবৃত,এরপর মাঝখানে কেন্দ্রে লেক,মনে হচ্ছে লেকের মাঝখানে পানির মধ্যে ভাসছে সংসদভবন।সংসদভবনকে দেখে এটা কতো তালা ভবন সেটা হিসাব করা যাবে না,স্বাভাবিক ভবনের মতো এটা দেখে বুঝা যায় না।তবে এটা নাকি দশতালা ভবন।সামনের অংশ দেখেই আমরা অবাক হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।তারপর সংসদ ভবনের পূর্ব দিক বরাবর হাঁটতে থাকলাম,এর পিছনে যে ক্রিসেন্ট লেক আছে সেটা দেখার জন্য।
কিন্তু সংসদ ভবনের সীমানাটা এতো বড় যে এর পিছনে যেতে দশ মিনিট হাঁটতে হয়েছে।পিছন দিক থেকে লেক সহ সংসদ ভবনের সৌন্দর্যটা আরও মনোমুগ্ধকর মনে হলো।প্রকৃতি আর মানবসৃষ্ট স্থাপনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে।সংসদ ভবনের পিছনের দিকে পূর্ব দিক বরাবর লাল রং এর ইটের তৈরি অনেকগুলো দালান।মোট কয়টি গণা সম্ভব হলো না।দালানগুলো দেখতে অনেকটা গোল কুয়োর মতো।পানির মধ্যে কুয়োগুলো ভেসে রয়েছে মনে হচ্ছে।এই ভবনগুলোতে যাওয়ার গেইটে লিখা রয়েছে সংসদ সদস্য ক্লাব।এতোগুলো কিসের ক্লাব,এখানে না জানি সংসদ সদস্যদের জন্য কি রাজকীয় ব্যবস্থা করা রয়েছে এসব ভাবতে ভাবতে ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সড়কটা দিয়ে সংসদ ভবনের পিছনের দিক দিয়ে পশ্চিম দিকে এগোতে থাকলাম।সামনের দিক দিয়ে যত সুন্দর পিছনের দিক দিয়ে আরও বেশি সুন্দর।একটি খেলার মাঠও দেখতে পেলাম।আর সংসদ ভবনের সীমানা প্রাচীরের ভিতরে সব এতো পরিষ্কার যে ঘাসগুলো পর্যন্ত চকচক করছে,মনে হচ্ছে যেনো,একটু পর পর পুরো সংসদভবন এলাকাটাকে কেউ ধুঁয়ে দিচ্ছে পানি দিয়ে।
পাশের সড়কটাকে মনে হচ্ছে, কোন উন্নত বিশ্বের সড়ক।একটু সামনে এগোতেই একটা ব্রীজ দেখতে পেলাম।ব্রীজের ঐ পারে চন্দ্রিমা উদ্যান।যা কিনা আগে ছিলো জিয়া উদ্যান।চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমান এর কবরস্থান।কবরের জায়গাটাও বিরাট একটা স্থাপনা ধারা বেষ্টিত করা রয়েছে।কিন্তু ভিতরে গিয়ে দেখতে পেলাম,স্থাপনাটা সুন্দর হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।এর কারণ জিয়াউর রহমান এর দল এখন ক্ষমতায় নেই।
চন্দ্রিমা উদ্যানে একটু ঘুরাঘুরি আর কবরটা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।এটাকে জিয়ার মাজারও বলা হয়ে থাকে।মাজারের পেছনের দিকে একটা মসজিদ রয়েছে।সেখানে গিয়ে দেখি এমন অবস্থা ফ্যান পর্যন্ত নেই।অথচ এখন ঢাকা শহরের কোনো মসজিদ এমন নেই যেখানে এসি ব্যবহার করা হয় না।যাইহোক মাগরিবের পর দেখলাম সংসদ ভবন আরও সুন্দর হয়ে ফুটে উঠলো আলোকসজ্জা করার কারণে।জিয়ার মাজারের পিছনের মসজিদে থেকে আমরা তা দেখতে পেলাম।কিন্তু ঐ মসজিদের আশপাশ বা জিয়ার মাজারে কোনো আলো জ্বললো না।কারণ ঐ একটাই তার দল এখন ক্ষমতাই নেই।রাস্তার এইপাশে রাত আর ঐ পাশে দিন,এমন একসময় ছিলো যখন ঐ পাশেও দিন ছিলো,এইপাশেও দিন ছিলো।
তারপর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বের হয়ে সংসদ ভবনের পিছনের রাস্তা ধরে হাটতে থাকলাম পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে।পশ্চিমের শেষ মাথা থেকে আবার উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর পুরোটা পারে হয়ে আবার সংসদ ভবনের সামনে যেতে আবার দশ মিনিটের বেশি লেগেছে।সংসদের ভবনটা একটা চক্কর দেওয়া গেলো অবশেষে।পুরোটার সৌন্দর্য দেখে আমরা অভিভূত হয়ে বাসায় চলে আসলাম।