ছোট বেলা একটা গল্প শুনেছিলাম। অবশ্য আমাদের আঞ্চলিক ভাষায়।একটা লোকের পরিবারে ছয়জন লোক। একজন তাকে জিজ্ঞেস করছে "সারাদিন কাম করে টেহা কি করস?"এখন সে উত্তর দিচ্ছে 'একশ টেহায় বিশ টেহা রিন দেই,তিরিশ টেহা নিজের জইন্য খর্চা করি,তিরিশ টেহা জমা রাহি, বিশ টেহা জলে ফালায়। "এর মানে হচ্ছে সে যা উপার্জন করে তার বিশ শতাংশ ধার পরিশোধ করে, ত্রিশ ভাগ নিজের জন্য খরচ করে, ত্রিশ শতাংশ ভবিষ্যতের জন্য জমা করে আর বাকী যে বিশ শতাংশ থাকে তা জলে ফেলে দেয়।
যে লোক প্রশ্ন করেছিলো সেই লোক ভাবতে লাগল সবই ঠিক আছে কিন্তু সবশেষে বলল বিশ শতাংশ জলে ফেলে দেয় সেটা কেন। টাকা কি কেউ পানিতে ফেলে দেই!তাই তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন এর মানে কি।এর মানে হচ্ছে তার পরিবারে ছয়জন সদস্য। তিনি যা উপার্জন করেন তার সবি খরচ হয়ে যায় তাদের পিছনে। বিশ শতাংশ খরচ হয় মা বাবার খাতে। মা-বাবা ওনাকে লালন-পালন করে বড় করেছেন তাই তিনি মা-বাবার কাছে ঋণী। সেটা ঋণ দেন। ওনার স্ত্রী আর নিজের খাতে খরচ করেন ত্রিশ শতাংশ যা তিনি নিজেদের খরচ বলেছেন।ছেলের খাতে যে ত্রিশ শতাংশ খরচ করেন তা তিনি মনে করেন ভবিষ্যতের জন্য জমা করছেন। কারণ বৃদ্ধ বয়সে ছেলে ওনার এবং ওনার স্ত্রীর দেখভালের দায়িত্ব নেবে।
রইল পড়ে বাকী বিশ শতাংশ যা তিনি নিজের একমাত্র মেয়ের খাতে খরচ করেন যাকে তিনি মনে করেন পানিতে ফেলার সমতুল্য।মেয়ের কাছথেকে কিছু পাওয়ার আসা নেই।এবার আপনার মনে হতে পারে বিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়ে এ গল্পের কোন মূল্য নাই। আগের দিনের মানুষ এমন ভাবতো এখন ভাবেনা। কথাটা সত্য মা বাবা কখনো এমন ভাবে না। বর্তমানে যুগের মা-বাবা তো আমার মনে হয় ছেলের থেকে মেয়েকে বেশিই ভালোবাসে। সবি ঠিক আছে। তবে কয়েকদিন আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে এই গল্পটা কার সৃষ্টি। এটা কি সত্যি কোনো বাবার কথা? হয়তো না,হয়তো হ্যাঁ।
কেনো হঠাৎ আমার মনে এ প্রশ্ন এলো এটা নিয়ে আজকের এতো সব কথা। আমার এক পরিচিত প্রবাসে থাকেন বহু বছর। গ্রাম থেকে যারা প্রবাসে যান তাদের সবার কাহিনী প্রায় একি এরকম। প্রথমে ঋণ করে প্রবাসে যান। এরপর ঋন পরিশোধ করতে কয়েক বছর কেটে যায়।এরপর যা টাকা উপার্জন করেন তা সংসারে খরচ করেন তার সাথে ভালো ভাবে একটা বাড়ি করতে চেষ্টা করেন।ব্যাংক ব্যল্যান্স কিংবা অন্যান্য সম্পদ করেন না বা করতে পারেন না। কিন্তু তিনি যেহেতু অনেক বছর প্রবাসে তাই তিনি জেলা সদরে জমি কিনে একটা বাড়ি করেছেন কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স ও করেছেন। ওনার তিন ছেলে মেয়ে। মেয়ে বড় আর দুই ছেলে ছোট।
মেয়ের বয়স ষোল এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। হঠাৎ একদিন বিয়ের প্রস্তাব এলো ছেলেরা সম্পদশালী। পুরান ঢাকায় সাত তলা বিশিষ্ট বাড়ি আছে আরও অনেক কিছু। ওনারাতো এক কথায় রাজি।ভালো জায়গায় মেয়ে বিয়ে দিতে কে না চায়। দেখাদেখি শেষ বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। এস.এস.সি পরীক্ষার পর বিয়ে। বাবা সব ঠিক করে বাড়ি চলে আসলো। যথারীতি বিয়ে বরের বাড়ির কোন দাবী নাই তবে বাবার মেয়ে বাবাকে নাকি সাজিয়ে দিতে হয়। এটা নাকি পুরান ঢাকার রীতি। মেয়ে থাকবে তাই বেড রুম সাজিয়ে দিতে হবে। আর জামাই কে শশুর আদর করে কিছু দিবে এটা নাকি দোয়া। বাবার একমাত্র মেয়ে তাই বাবারও আপত্তি নেই।মেয়ের গয়না, আসবাবপত্র,জামাইয়ের দোয়ার ব্যবস্থা করতে বাবার জমানো টাকা প্রায় শেষ। এরপর তিনশত বর যাত্রী আরও তিনশত এলাকার লোকের ভূরিভোজনের ব্যবস্থা আর বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকের উপহার সামগ্রী দিতে ওনার আরও পাঁচ-সাত লাখ টাকা ঋণ হয়ে যায়। তাতে ওনার মন খারাপ হয়নি কারণ প্রবাসে এসে কাজ করে দিয়ে দিবেন। মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে এটাই বড় শান্তি।এবার প্রকৃতি ওনার পরিকল্পনায় বাধ সাধে।দুই হাজার বিশ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেয়ে বিয়ে দিয়ে মার্চের মাঝমাঝিতে তিনি প্রবাসে ফিরে যান।
এক সপ্তাহ না পেরুতেই লকডাওন। কাজ নেই। নিজের থাকা খাওয়ার খরচ যোগানো কঠিন। এদিকে এমাস যেতে না যেতেই রোজা চলে আসে। মেয়ে ফোন করে বাবাকে বলে শ্বশুর বাড়িতে ইফতার পাঠাতে হবে। অল্পতে হবে না চাচি শ্বাশুড়ী, ফুফু শ্বাশুড়ী,জেঠাই শ্বাশুড়ী সবাই কে দিতে হবে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন কতো টাকা লাগবে। মেয়ে বলে দিয়েছে ৫০-৬০ হাজার টাকা হলে হয়ে যাবে। বাবা আবার একজনের থেকে ধার করে পাঠালেন। পনেরো দিনের লকডাউন একমাস হয়ে গেলো। ওনি হয়তো রুমে বসে সিগারেট খেতে আর ঋণ কিভাবে দিবেন তাই ভাবতেন।এভাবে বসে থেকে থেকে ওনার ছোট মাইল্ড এটাক হলো। হাসপাতালে নেওয়া হলো । ডাক্তার বলেছে তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। প্রবাসে অপারেশন করলে চার লাখ টাকা লাগবে।দেশে নাকি বিশ হাজারে হয়ে যাবে। তাই বাড়িতে আসার ব্যবস্থা করলেন। এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথে আবার পেসার স্টক করলো। ওনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। এলোমেলো কথা বলেতেন আর ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবেন এসব বলতেন।এর কিছুদিন পর তিনি মারা গেলেন। সুস্থ একটা মানুষ মেয়ে বিয়ে দেওয়ার চক্করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো।মেয়ে হয়তো জানতেও পারেনি বাবার মৃত্যুর জন্য সে দায়ী।
এতো গেলো একটা ঘটনা এমন হাজারো ঘটনা প্রতিদিন ঘটে। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা তার বসতভিটা বাড়ি বিক্রি করে দেয়। সেই বাবা অসুস্থ হলে মেয়ে অনেক সময় দেখতে আসে না,কারণ সংসারের বিভিন্ন সমস্যা। এসব দেখে দেখে কোন বাবা যদি ভাবেন মেয়ের পিছনে খরচ করার কোন ফল নেই তাহলে কি খুব ভুল হবে! নাকি এটা না ভাবাটাই অস্বাভাবিক!
Congratulations @shaonashraf! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!