বাসের অপেক্ষায় বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।ওমা,এটা আবার কেমন কথা!বাস স্টেশনেতো মানুষ বাসের অপেক্ষায় করবে নাকি?না আমি আবার মাঝে মধ্যে অন্য কারণেও বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকি।
চিন্তা-ভাবনা মানব মস্তিষ্কের একটি অতি স্বাভাবিক ক্রিয়া।একেক মানুষের কাছে একেক জায়গা প্রিয়, চিন্তা-ভাবনা করার জন্য।প্রিয় বলতে একেক মানুষ একেক জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে চিন্তা-ভাবনা করতে।কেউ দেখা যায়,খেতে খেতে চিন্তা-ভাবনা করে,তখন তার চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয়,অনেক কিছু যা অন্য সময় তার পক্ষে ভাবা সম্ভব হয় না, এমন জিনিসও সে অনায়াসে ঐ সময় ভাবতে পারে,মাথায় নতুন নতুন বুদ্ধি আসে।কারো মাথায় আবার সারাদুনিয়ার চিন্তা ঘুরপাক খায় ঘুমানোর আগে যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করে।তখন তার চোখের সামনে সব কিছু ত্রিডি পর্দার মতো ভেসে উঠে।
আবার অনেকে এমনও আছে,যারা ওয়াশরুমে বসে চিন্তা-ভাবনা করে।তো বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনার স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গার মতো আমারও একটা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা রয়েছে।আর সেটা হচ্ছে বাস স্টেশন।
আমার কাছে মনে হয়,শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বাস স্টেশন।অবশ্য বড় বাজারগুলোতে তার চেয়ে বেশি ভীড় থাকতে পারে।তবে বাস স্টেশনের চাঞ্চল্যতা ভিন্ন ধরনের।বাসের হেলপাররা সারাক্ষণ হাকডাক করছে তার বাসে উঠার জন্য,যাত্রীরা দৌড়াদৌড়ি করে বাসে উঠছে,বাস আসছে অল্প একটু থেমে আবার চলে যাচ্ছে,কেউ বাসের পিছনে দৌড়াচ্ছে, আবার কেউ বাস থেকে নামছে এসব সারাক্ষণ চলতেই থাকে।বাজার বা অন্যান্য ভীড়ের স্থানগুলোর ক্ষেত্রে প্রধান উপকরণগুলো স্থির থাকে।যেমন,দোকানগুলো স্থির থাকে,মানুষ জন গিয়ে জিনিসপত্র কিনে।কিন্তু বাস স্টেশনের প্রধাণ উপকরণ বাস কখনও স্থির থাকে না,হুট করে আসে, যাত্রী নামিয়ে, আবার উঠিয়ে দ্রুত চলে যায়।থেমে থাকে না বলে একটা গতিময়তা রয়েছে।
চারপাশে যখন প্রচন্ড গতিময়তা সেই স্থানটিই আমার চিন্তা-ভাবনা করার স্বাচ্ছন্দ্যের স্থান।বাস স্টেশনে যেখানে বাস থামছে আর যাত্রীরা উঠছে নামছে,এমর জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা চিন্তা করতে পারি এবং আমার কাছে তখন সবকিছু খুব স্পষ্টভাবে ধরা দেয়।জীবন-জগতের সব সমীকরণ তখন খুব সহজেই মিলতে থাকে।চারদিকে গতিময় পরিবেশ তার মাঝে আমি স্থির দাঁড়িয়ে চিন্তারত।
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ি তখন।বাসা থেকে কলেজের দুরত্ব ছিলো ভালোই,বাসে যাতায়াত করতাম নিয়মিত।সাড়ে আটটায় ক্লাস শুরু হতো।আমি প্রস্তুত হয়ে সাড়ে ছয়টার পর বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম।কারণ সাতটার পর বাসে খুব ভীড় শুরু হয়।আমাদের খিলক্ষেত বাস স্টেশন।সকালবেলা ঐ সময়টায় প্রচুর ভীড় থাকে।অফিস-আদালতে এবং স্কুল-কলেজের সময় একি হওয়ায় সবাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ভীড় জমায় এক সাথে।সকাল সাতটার পর এই বাস স্টেশন পরিণত হয় জনসমুদ্রে।সবাই নিজের গন্তব্যে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর।কিন্তু যে বাসে যেতে হবে সেটার আসনতো সীমিত।তাই সবাই লড়াই করে নিজের আসনটা দখল করার জন্য।
এই লড়াইটা শুরু হয় সকাল সাতটার পর থেকে।আমি প্রায়ই চেষ্টা করতাম সাতটার আগে বাস স্টেশনে পৌঁছাতে এবং সাতটার আগেই বাসে উঠতে।কিন্তু স্টেশনে যাওয়ার পর বাস আসে,মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করে বাসে উঠার জন্য,কিন্তু আমার দৌড়ানোর স্পৃহা কখনই থাকতো না।আমি সেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে চিন্তার জগতে ডুবে যেতাম।একের পর এক বাস আসতো আর দৌড়াদৌড়ি করে,লড়াই করে যারা আসন দখল করতে পারতো,তারা বিজয়ী হয়ে রওনা দিতো।আসন দখল বলতে বাসে অল্প একটু জায়গা পেলেই হবে দাঁড়ানোর জন্য।অন্তত বাসের পা দানিতে একটা পা রাখার জায়গা পেলেও সেটা আসন দখলের সমতুল্য হিসাবে গণ্য হবে এবং সে বিজয়ী হয়ে গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা দিবে।
এই দৌড়াদৌড়িটা সবচেয়ে বেশি চলে সকাল সাতটা থেকে সাতটা পয়তাল্লিশ পর্যন্ত ।আমি যদি ছয়টা পয়তাল্লিশ এ স্টেশনে পৌঁছাতাম তবে দেখা যেতো, এসব লড়াই এর মধ্যে না গিয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে করতে সাতটা পয়তাল্লিশ বেজে যেতো।তখন আমার টনক নড়তো,আরে আমার না সাড়ে আটটায় ক্লাস শুরু।তখন অবশ্য এতোক্ষণে ভীড় কমে গিয়েছে,আমি সহজেই উঠে চলে যেতাম তখন।তাহলে এতো আগে বাস স্টেশনে আসার দরকার কি?
ঐ যে চলেতো যেতাম ঠিকই, কিন্তু সবসময় এমন হতো যে বাস থেকে নেমেই কলেজের দিকে দৌড়ে যেতে হতো,আমিও ক্লাসে ঢুকতাম আর স্যারও ক্লাসে ঢুকতো,মাঝেমধ্যে স্যার আগে ঢুকে যেতো।বাস থেকে নামার পর যাতে এই দৌড়াদৌড়িটা করতে না হয়,তাই প্রতিদিন ভাবতাম আগামীকাল আগেভাগে বাসে উঠে চলে আসবো,এই কারণে আগে স্টেশনে যাওয়া।কিন্তু বিধিবাম কখনও আগে বাসে উঠতে পারতাম না।
এখন কলেজ থেকে বাসায় ফেরত যাওয়ার পথেতো আর কোনো তাড়া নেই,মানে ক্লাসে সঠিক সময়ে পৌঁছার মতো কোনো শর্ত নেই।সেই সময়টা আমি যে বাস স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াতাম আর রাজ্যের সব চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসতো।সেগুলোকে লালনপালন করতে করতে প্রচুর সময় চলে যেতো।বেপারটা আবার এমন নয় যে,বাস আমার সামনে এসে সুন্দরমতো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু আমি উঠছি না।বেপারটা হচ্ছে,আমি গিয়ে বাস স্টেশনে দাঁড়ালাম,যেহেতু একসাথে পুরো কলেজের সব শিক্ষার্থীদের ছুটি দেওয়া হয়েছে সবাই বাসাই যাবে,তবে স্টেশনে খুব ভীড় হতো,এখানেও বাসে উঠার জন্য সবাই লড়াই করতো।আমি এসব লড়াই এর দিকে মনোযোগ না দিয়ে এক মনে ভাবতে থাকতাম বিভিন্ন কিছু।হয়তো একটু চেষ্টা করলে আমিও বাসে উঠতে পারতাম,কিন্তু এই ঝামেলার মধ্যে আমি যেতাম না।আবার বাস একেক সময় একেক জায়গায় দাঁড়াতো,হয়তো আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে না দাঁড়িয়ে একটু সামনে দাঁড়ালো,আমি আর কসরত করে সামনে যেতাম না।যাইহোক,এভাবে আমার আশপাশে গতিশীল অবস্থা বিরাজ করতো,সবাই বাসে উঠতো নামতো,আর আমি এক টানা দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকতাম,এসব দিকে আমার মন নেই।এভাবে যখন পুরো স্টেশন শান্ত হয়ে যেতো, সবাই এতোক্ষণে চলে গিয়েছে,আমি তখন বাসে উঠতাম।
চিন্তা-ভাবনা বলতে সবসময় খুব গুরুগম্ভীর কিছু হবে বেপারটা এমন না।একজন কিছু নিয়ে চিন্তা করছে মানে সে নতুন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলবে বেপারটা এমনও না।আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো ঐ ধরনেরই,প্রাত্যহিক জীবনের চিন্তা-ভাবনা।তবে সেটাতো আর মস্তিষ্কে সব সময় তেমন প্রভাব ফেলে না,একেকজনের একেক জায়গায় প্রভাব ফেলে,আর আমার সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বাস স্টেশনে।বাস স্টেশনের গতিময় পরিবেশে আমি সবচেয়ে বেশি নির্ভুল ভাবনা ভাবতে পারি।