বইমেলা!

in BDCommunity3 months ago

২১শে বইমেলা আমার কাছে একটা নস্টালজিয়া। বইমেলা নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন তৈরি করার পিছনে দায়ী মূলত দুইজন। আমার বাবা-মা। ছোটবেলায় আর কোথাও যাওয়া হোক না হোক, প্রতিবছর বইমেলায় যাওয়া হবেই। বই পড়ার বয়স যে সময় থেকে হয়েছে তখন থেকেই পুরো পরিবার নিয়ে বাবা মেলায় যেতো। আমাদের চার জনের কাঁধেই থাকতো চারটা থলে। যার যার বই তার তার থলেতে রাখা হতো। তখন তো কোন বই ভাল তা তো অত বুঝতাম না, প্রচ্ছদ আর ভেতরের ফন্ট সুন্দর হলেই নেয়ার জন্য আবদার করে বসতাম। আমাদের পছন্দ মতন কেনার পর বাবা আমাদের জন্য জুতসই বই কিনে দিতো।

এখনও মনে আছে বাবা সেই সময়ে একবার রবীন্দ্রনাথের “সহজপাঠ” বইটা কিনে দিয়েছিল। দেখতে সুন্দর ছিল না বলে আমি নিতে চাই নাই, অনেকটা জোর করেই তখন কিনে দিয়েছিল। কেনার পর সেই বই প্রায় ৪/৫ বছর পর ভালো মতন পড়ে দেখেছিলাম। শান্তিনিকেতনে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য সহজ ভাষায় ছড়া কবিতা গল্প সব কিছুর মিশেলে লেখা হয়েছিল এই বই। সেদিন পড়ে বুঝেছিলাম এই বই কেনো আমাকে দেয়া হয়েছিল! ওই বইয়ের কবিতাগুলা এখনও মাঝে মধ্যে মনে পরে।

একটু বড় হওয়ার পর ছোটমামা একদিন নতুন এক লেখকের বই নিয়ে আসলো। “বাচ্চা ভয়ংকর, কাচ্চা ভয়ংকর”। এটা ছিল আমার জাফর ইকবালের পড়া প্রথম গল্প। এই জিনিস আমার কাছে নতুন এক জগত খুলে দিলো! এত সুন্দর, মজা করেও গল্প লেখা যায়?! এরপর থেকে হয়ে গেলাম জাফর ইকবাল ফ্যান! বইমেলায় যাওয়ার আগে প্রথমআলো দেখে আমি আর আমার ছোটবোন বইয়ের লিস্টি বানাতাম। বাসায় একজন বিশাল বড় হুমায়ূন ফ্যান থাকায় (আম্মু) তার বইও পড়া হতো।

হাইস্কুলে উঠে সিক্সে ভালো রেজাল্ট করায় স্কুল থেকে বই দিয়েছিল। “টিনটোরেটোর যীশু”। এই বই এক ঝটকায় আমার সামনে আরেক জগত মেলে ধরলো! গোয়েন্দা কাহিনীর পৃথিবী। এরপর হয়ে গেলাম ফেলুদার বিশাল বড় ফ্যান (যেটা এখনও আছি! সত্যজিতকে কেও হার মানাতে পারেনি!)। এরপর বইমেলায় গেলে নওরোজ প্রকাশনী থেকে সিংগেল সিংগেল একেকটা ফেলুদার বই কিনতাম। একদিন সেভেনের ম্যাথ কোচিং এ আমার এক ফ্রেন্ডকে দেখলাম ফেলুদার বিশাল বড় মেরুন কালারের সমগ্র নিয়ে পড়ছে। সব ফেলুদার গল্প এক বইয়ে! দেখে যে কি লোভ লেগেছিল! দাম বেশি হওয়ায় সেই সমগ্র আমার কেনা হয় নাই। এখন পর্যন্তও না।

বাংলা নানা লেখকের পাশাপাশি কলেজে উঠে এরপর ইংলিশ নভেল পড়া শুরু করি। kite runner, me before you এগুলা ছিল আমার প্রথম দিককার ইংরেজি নভেল। খালিদ হোসেইনের লেখার উপমা, মাধুর্য দেখে তার বিশাল বড় ফ্যান হয়েগিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাবজেক্টের সুবাদে অনেক ইংরেজি সাহিত্য এরপর পরার সুযোগ হয়। সেই সাথে অন্যান্য ভাষার উপন্যাসও।

ক্যাম্পাস থেকে বইমেলা কাছে হওয়ার কারণে তখন ফ্রেন্ডদের সাথেই মেলায় বেশি যাওয়া হতো। বাবা আম্মুর সাথে মেলায় ঘুরার দিনগুলার ইতি হলো। স্টুডেন্ট লাইফে তখন একলা যেতাম বলে বেশি বই কেনা হতো না। বাজেট থাকতো কম। এক মাস আগে থেকে করা বইয়ের লিস্টগুলা থেকে কেটে ছেঁটে বেস্টগুলা রাখা হতো।

আমার একটা অভ্যাস ছিল মেলার প্রত্যেকটা স্টলের বই ঘুরে দেখার। সাথে আসা আমার ফ্রেন্ডরা মাঝে মাঝে এজন্য বিরক্তও হতো, পা ব্যথা করে কার এত হাটার ধৈর্য আছে! আমি একবার ৫০০ টাকা দিয়ে আখতারুজামান ইলিয়াসের সমগ্র কিনেছিলাম বলে আমার বেস্টফ্রেন্ড ভয়ংকর লেভেলের অবাক হয়েছিল, “৫০০ টাকা দিয়ে কেও একটা বই কেনে?! আমাকে এই টাকা দিলে একটা ওয়ান পিস কিনে নিতাম।” ওর কথা শুনে আমি খালি একটু হেসেছিলাম, কিছু বলি নাই।

আমাদের পছন্দ অপছন্দের অনেকটুকুই নির্ভর করে আমাদের পরিবারের উপর। কিভাবে আমাদের বড় করা হচ্ছে তার উপর। আমি জন্মের পর থেকেই দেখছি বাবা সারাদিন বই নিয়ে থাকে। আম্মুর সাথে বাবার ঝগড়ার অন্যতম একটা পয়েন্ট ছিল এই বই। বাবা সবখানে বই ছড়ায় রেখে দিত। এখনও বাসায় গেলে ডাইনিং টেবিল, সোফা, বিছানা, ওয়াড্রোবের উপর সবখানেই বই পাওয়া যায়। প্রতিবারই আম্মুকে এসব গুছায় রাখতে হয়। বাবা আম্মু দুইজনেরই বই পড়ার বাতিক থাকায় তাদেরকে দেখেই আমাদের এই পড়ার অভ্যাসটা কিভাবে কিভাবে জানি হয়ে গেছে।

এখন আমরা নতুন জেনারেশনকে প্রায়ই বলি তারা বই পড়েনা। দোষ দিতে চাইলে খুব সহজেই দিয়ে দেয়া যায় কিন্তু আমরা কি তাদের বই পড়ার জন্য পরিবেশ করে দিচ্ছি? আমরা নিজেরাই এখন বছরে কয়টাই বা বই পড়ি? যেখানে আমাদের দেখেই ছোটদের শেখার কথা সেখানে আমরাই সারাক্ষণ ফোনের ভেতর ব্যস্ত। আমরা যা করি সেটাই যে বাচ্চারা ফোলো করবে এটাই স্বাভাবিক।

তবে বলবো একদিক থেকে আমরা আসলেই ভাগ্যবান, আমাদের ছোটবেলায় স্মার্টফোন ছিল না। যার জন্য পড়ার ধৈর্য এবং সময় কোনটাতেই কমতি ছিল না। এখনকার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই দুইটা জিনিসই ম্যানেজ করা বেশ মুশকিল।

1708418179504.jpg

বইমেলা কেনো এখন আর আগের মতন টানে কিনা এটা জিজ্ঞেসা করলে প্রায় সবার থেকেই নেগেটিভ উত্তর আসে। অনেকেই বলে পছন্দের লেখকরা এখন আর নাই, বা ইনফ্লুএন্সাররাও যখন লেখক হয়ে যায় তখন আর মেলা থেকে ভালো বই পাওয়ার আশা করা যায় না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় নতুন লেখকদের কিছুটা হলেও এক্সপ্লোর করে দেখা উচিত। আমি নিজেও ক্লাসিক লেখক ছাড়া বাকিদের বই তেমন একটা পড়তাম না। এবার মেলা থেকে ইচ্ছা করেই রিসেন্ট রাইটারদের বেশ কিছু বই নিলাম। দেখার জন্য তারা কেমন লেখে। আমাকে কেউই হতাশ করে নাই। থ্রিলার ধাঁচের তিনজন রাইটারের লেখাই পড়ে দেখলাম যথেষ্ট সময় আর প্রচেষ্টা দিয়েই লেখা হয়েছে। পড়া শেষ হলে প্রতিটা নিয়েই বুক রিভিউ দেয়া হবে!

1708418094924.jpg

সববারের তুলনায় এবারের বইমেলা আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা ছিল। বাবা মা, বন্ধু বান্ধবের পর এবার নতুন পরিবার নিয়ে মেলা ঘুরে আসলাম। স্পেশাল হিসেবে দুইটা জিনিস ছিল। এবার আমার বই বহন এবং কিনে দেয়া দুইটার জন্যই একজন পাশে ছিল। যার সুবাদে ইচ্ছা মতন বই কেনা হয়েছে। দুইজনেরই থ্রিলার পছন্দ হওয়ায় বেশিরভাগ বইই এই জনরার হয়ে গেছে। বই পড়ার যে আলাদা একটা প্রশান্তি তা অনেক দিন পর আবার একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছি। এই ভালোলাগাটা অন্যরকমের। কিছুর সাথে তুলনা হয় না!

1708418094944.jpg