"অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট" -রিভিউ

in BDCommunity15 days ago

কোনো বই পড়ে কি নিজেকে কখনও লাকি মনে হয়েছে? মনে হয়েছে এত সুন্দর বই পড়ে জীবন সার্থক!

আমার হয়েছে। “অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” বইটা শেষ করার পর প্রথম এই কথাই মাথায় এসেছে
-উপরওয়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ, আমাকে এত সুন্দর একটা বই পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য!

কোন ধরণের সাজেশন বা রিভিউ, মানে একেবারে কিছু না জেনেই একদিন হুট করেই একদিন এই বইটা ধরেছিলাম। তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই একটা অসাধারণ বই পড়তে যাচ্ছি। যেই বইয়ের ক্ষমতা আছে যে কাউকে একদম ভেতর থেকে নাড়া দেয়ার।

বইটা এতটাই অসাধারণ যে আমার মোস্ট ফেবারেট বইয়ের টপচার্টে একে নিয়ে এসেছি। পড়া শেষে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম, আমার মতন অনেকেরই সবচেয়ে পছন্দের বই হলো এটা।

আরও জানলাম জার্মানিতে একসময় সবার বাসায় বাইবেলের মতন রাখা হতো এই বই। পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালের নাৎসি বাহিনীর বই পোড়ানোর “উৎসবে” সবার বাসা থেকে এই বইটিও জোগাড় করে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই সময়ের জন্য এটা হয়ে উঠলো নিষিদ্ধ বই! তবে এর আগেই বইটি ছাপানোর ১৮ মাসের মধ্যেই ২২ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। যার ফলে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারেনি এই মহামূল্যবান শিল্পকর্মটি!

সত্যি কথা বলতে আমি আর আমার বোন সব সময়ই যুদ্ধের বই বা সিনেমা থেকে একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। কারণ যুদ্ধের অমানবিক কষ্ট সহ্য দেখতে বা পড়তে স্বাভাবিক ভাবেই খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু আমার বন্ধু রাশেদ, Dunkirk, 1917 সবকিছুর কষ্টকে এই বই হাজার গুণে ছাড়িয়ে গেছে।

বইটা পড়তে গিয়ে মাঝ পথে এমন কিছু বীভৎস বর্ণনা ছিল যে প্রায়ই আমাকে থেমে যেতে হয়েছে। কোন ভাবে আগাতে কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে সময় দিতে হয়েছিল, কাহিনী হজম করার জন্য। কিন্তু এত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শোনার পরেও একবারের জন্য মনে হয় নাই যে আর আগাবো না। রেমার্কের লেখা এতটাই অসাধারণ যে যুদ্ধের যতই ভয়াল বর্ণনা থাকুক না কেন, আপনি পড়তে বাধ্য!


আমরা কি আসলে কখনও ভেবে দেখেছি যুদ্ধে একজন সৈনিকের মনের অবস্থাটা ঠিক কি রকম হয়? কতই তো যুদ্ধ দেখছি, পেপারে ইউক্রেন, প্যালেস্টাইনের যুদ্ধের কাহিনী দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পরের পাতায় চলে যাচ্ছি। এদিকে অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট শেষ করেছি প্রায় এক সপ্তাহরও বেশি হলো, কিন্তু এখানের যুদ্ধের বর্ণনা এখনও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, এটাই তো লেখকের সার্থকতা, তাই না?

কাহিনী বলতে গেলে বইটা শুরু হয় জার্মানির একদল ১৭/১৮ বছরের কিশোরদের নিয়ে। স্কুল থেকে এক শিক্ষকের পাল্লায় পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা নাম লিখিয়েছে। ভেতরে তখন দেশকে বাঁচানো নিয়ে উত্তেজনা ভরপুর। কিন্তু তখন কে জানতো যেই উদ্দেশ্য নিয়ে তারা মাঠে নামছে তার সাথে যুদ্ধ লাগাবার মূল হোতাদের লক্ষ্য এক না। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কোন ধরণের ট্রেনিং ছাড়াই লাখ লাখ কিশোরকে ফ্রন্টে পাঠিয়ে দেয়া হতো, কোন ধরণের অভিজ্ঞতা না থাকায় যারা পাখির ঝাকের মতন শত্রুর গুলিতে মারা পড়তো। যুদ্ধে হার হচ্ছে নিশ্চিত জেনেও সৈনিকদের মাঠ ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয় না।

51Ty14h+qQL._AC_UF1000,1000_QL80_.jpg
source
যুদ্ধে যাওয়ার আগের আর পরের এই কিশোরদের মধ্যে এক আকাশ পাতাল পরিবর্তন চলে আসে। বলা হয় একজন নতুন সৈনিকের ক্ষেত্রে মাঠে প্রথম যেই বোমাটা ফাটে সেটা প্রথমে বিস্ফোরিত হয় তার মনের ভেতরে। গুড়িয়ে দেয় মন-মানবিকতা-বিবেক-অনুভূতি সবকিছুকে। এরপর ফ্রন্টলাইনে যারা থাকে তাদের সাথে পশুর কোন তুলনা হয় না।

“We're no longer young men. We've lost any desire to conquer the world. We are refugees. We are fleeing from ourselves. From our lives. We were eighteen years old, and we had just begun to love the world and to love being in it; but we had to shoot at it. The first shell to land went straight for our hearts. We've been cut off from real action, from getting on, from progress. We don't believe in those things any more; we believe in the war.”

যুদ্ধের এক পর্যায়ে গল্পের ন্যারেটর পল ভুল করে শত্রু পক্ষের ট্রেঞ্চের কাছে চলে যায়। ওর লুকিয়ে থাকা গর্তে পা পিছলে এক শত্রু পড়ে যায়। এই প্রথম কোন শত্রুকে এত কাছ থেকে চাকু দিয়ে মারতে হয় পলের। আর এই কাজ করার পর পলের প্রথমবারের মতন মনে হয়,

But now, for the first time, I see you are a man like me. I thought of your hand-grenades, of your bayonet, of your rifle; now I see your wife and your face and our fellowship. Forgive me, comrade. We always see it too late. Why do they never tell us that you are poor devils like us, that your mothers are just as anxious as ours, and that we have the same fear of death, and the same dying and the same agony--Forgive me, comrade; how could you be my enemy?

ফ্রন্ট লাইনে থাকা কালীন সময়ে যুদ্ধ শেষে বাসায় ফিরে যাওয়ার আশাই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে কেউ যখন আসলেই বাসায় ফিরতে পারে তখন বুঝা যায় কোন কিছুই আর আগের মতন নাই। কেউ যুদ্ধফেরত সৈনিককে আট দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতন দেখতে পারে না। দেখা হলে সবাই জিজ্ঞেসা করে যুদ্ধের নির্মমতা। কিন্তু সেই কাহিনী আসলে বলার মতন না।

“We have so much to say, and we shall never say it.”

যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে থাকার জন্য ঘরে ফিরলেও কেউ আসলে তা ভুলে থাকতে পারে না।


বইটার যেই জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে তা হলো লেখকের জীবন নিয়ে চিন্তা করার ধরণ।

সে এমন ভাবে প্রতিটি ঘটনা তুলে ধরতে পেরেছে যেটা পড়ে মনে হচ্ছিল আমি নিজেও ফ্রন্ট লাইনে ট্রেঞ্চের ভেতরে লুকানো, গুলি থেকে বাঁচতে কোন একজনের কবরে আশ্রয় নিয়ে আছি, কফিনকে শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করছি, গ্যাসমাস্ক পড়ে আমারও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে এত কষ্টের মাঝেও ভেতরের দুরন্তপনা মাঝে মাঝে উঁকি দিতো। রাজহাসের রোস্ট খাওয়ার আশায় রাতের অন্ধকারে চুরির ফন্দি আটা, রুটির ফাঁদ পেতে ইঁদুরের ঝাক মারা, হিমেলস্টসকে রাতে ঝোপের আড়ালে উচিৎ শিক্ষা দেয়া এসবই ছিল যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে থাকার এক ধরণের টনিক।

যুদ্ধে কাছের মানুষকে হারানোর কষ্ট দেখানো হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পলের বন্ধুগুলা কোন ফাঁকে যে আমারও বন্ধু হয়ে গিয়েছিল এটা ধরতে পারিনি। (স্পোয়েলার এলার্ট) বুঝতে পেরেছি যখন পলের সর্বশেষ বেঁচে থাকা বন্ধু ক্যাটকেও মরতে দেখতে হয়। এসময়ে এমন ভাবে কেঁদেছিলাম মনে হচ্ছিল নিজের কাছের কেউ মারা গেছে। এই কষ্ট আসলে বলে বুঝানোর মতন না!

বইটা আসলে কেনো আমার এত বেশি ভাল লেগেছে এই প্রশ্ন হয়তো এত কথা বলার পরেও দিতে পারলাম না। কোন বই যখন খুব বেশি ভাল লাগে তখন কি ছেড়ে কি বলবো এটা গুছাতে পারি না!

পড়তে গিয়ে আমার অনেকবারই মনে হয়েছে এত গভীরে লেখক কিভাবে যাচ্ছে, যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে না থেকে কেউ কি এত নিখুঁত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে পারে? এভাবে কি বানিয়ে লেখা সম্ভব? পড়া শেষে যখন দেখলাম লেখক আসলে নিজের জীবন থেকে নেয়া গল্পই লিখেছে, মেইন ক্যারেক্টার পল আসলে তার নিজেরই নাম (লেখকের আসল নাম “এরিক পল রেমার্কে”, পল পরিবর্তন করে মারিয়া দিয়েছে তার মায়ের নামকে স্মরণ করে)।

সবশেষে বলবো সুযোগ পেলে অবশ্যই এই বই নেড়েচেড়ে দেখবেন। এত চমৎকার জিনিস জীবনে একবার হলেও পড়ে দেখা উচিৎ!

happy reading!!

Sort:  

গল্পকথন বাই কল্লোল চ্যানেলে শুনেছিলাম। অসাধারণ একটা বই! যুদ্ধে আসলে কেউই জিততে পারে না!
ভালো লিখেছেন ☺️

আরেহ! আমিও এখান থেকেই পড়েছি! অডিওবুকের মধ্যে কল্লোলের চ্যানেলটাই বেশি ভাল লাগে! এত প্রাণবন্ত তার পড়ার ধরণ!

জি, আমার কাছে মনে হয় তারটাই অডিওবুক, বাকি সব বেতার নাট্য 😅😅😅