চারদিকে হৈ চৈ, উৎফুল্ল পরিবেশ,হাসিখুশি মুখগুলো যেন বলছে, স্বাগতম! এ ধরনীতে তোমায় বরণ করে নিতে সবাই আমরা ছুটে এসেছি ; দেখো, দেশ-বিদেশে সুদূর সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে এই বদ্ধ ঘরে। অজস্র উপহার থরে-বিথরে সাজানো, মুহুর্মুহু কলরবে মুখর পুরোটা বাড়ি, সবাই যেন হাতছানি দিয়ে বলছে,কতখানি আনন্দিত আমরা এ নব অতিথি পেয়ে, এ যেন স্রস্টার তরফ থেকে পাঠানো উপহার, এ যেন ঠিক স্বর্গীয় দূত। স্বাগতম, সু-স্বাগতম। এসো, হে এসো।
নবজাতকটির ক্ষেত্রে এ যেন এক অকস্মাৎ দৈব আবির্ভাব, কোথায় ছিলাম ঘুমন্ত এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে, কি শুনশান নীরব ছিল অন্ধকার সে দিনযাপন, এখন শুধু কেবল আলো ;অনাবিল আলোর ঝলকানি, চোখ যে বন্ধ হয়ে এলো! ঠিক সেই মুহূর্তে স্বরতন্ত্রী কেঁপে উঠলো, এক অস্ফুট গোঙানীর শব্দ ভেসে ভেসে গলা জড়ানো কান্নায় রূপ নিল, কোথায় ছিলাম আমি, এখন এলাম কোথায়? পুরো ঘরজুড়ে কি বৈপরীত্য - সবাই খুশির কোলাহলে মত্ত,নবাগতের দুঃখভরা হুতাশ।
তারপর তাকে পানিতে ভেজানো হয়, নতুন নাম দেয়া হয়, প্রথম সে ভুবন ভোলানো ধ্বনি - অর্থহীন কিন্তু মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে যায়, মা এবং মায়া, দুটি শব্দ যেন পিছু ছাড়ে না, অপত্য স্নেহে বয়ে নিয়ে যায় সারাটি বেলা,পৃথিবীতে দিন পার করার খেলায়, বেড়ে ওঠায় বসন্তে কিংবা শরতের দিনে,প্রথমবার মায়ের কোল থেকে বাবার বাহুডোরে, ছোট্ট করে শিশুটির হাতের একটি আঙুল, অনামিকায় ধরে রাখা, কত শক্ত যে সে বাঁধন, কত দায়িত্বশীল সে ধরে রাখা, সারাটি জীবন ধরে অটুট যে টুটি, যা বৃষ্টি কিবা গ্রীষ্মের রৌদ্র, হিম করা শীতের কামড় থেকে তপ্ত দুপুরে একটি হাতপাখা হাতে গা জুড়ানো, মানিক আমার, কোথায় কেমন আছে?
Source
রুক্ষ দুপুরে যে সময় শিশু-শিক্ষালয় থেকে বাড়ি ফেরা, মায়ের সনির্বদ্ধ তাগাদা দেয়া, ছুটির সময় হয়ে এলো বলে, আর বাবা একটি ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়া, কি বৃষ্টি, কি বিষম ঝড়, কি ছাতিফাটা গরমের দাহ, গায়ে সয় না, ও যে অনামিকার বাঁধনে বাঁধা, প্রানের চেয়ে যাকে ভালোবাসা, নিদারুণ অপত্য স্নেহে বড় করে তোলা, হাঁটি হাঁটি পা পা করে জীবনের দু চার কদম এগিয়ে দেয়া - এ তো অন্ধ মোহ, যা কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায় না, জীবনের শেষে যার পরিণতি।
কখনোবা মায়ের বকুনি, পড়ালেখায় অনীহার মধ্যম ঔষধ প্রয়োগ, তো বাবার সুশীতল বুকে শান্তিতে নিদ্রা যাওয়া, ছোট এতটুকুন মনে যেন সে কী মোক্ষম দীক্ষা -এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় এ জগতে নেই,কারন বাবা সব অনুযোগ থেকে দূরে রাখবে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর ছোটবড় বিষয়, তার চারপাশের ভালোমন্দ বুঝতে শেখা, ছোট্ট একটা চারপেয়ে বেষ্টনীর পালঙ্ক থেকে ঘরের মেঝে,বারান্দাটার গ্রিলের সীমা থেকে বাড়ির উঠোন, চৌহদ্দি থেকে পাড়ার রাস্তাটার কিনারা, নিজ শহর থেকে অন্য শহরে গত্যান্তর ;কোন একদিন মাতৃভূমিটা ছেড়ে অন্য মুলুকে জীবনের প্রয়োজনে--- ততদিনে কচি পুঁচকে ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেছে।
আঠারোর নবযৌবনে তার নিজের হয়ে চলতে শেখাটা, বাবার হাত আর অত সহজে ধরা যায় না, সঙ্কোচের প্রথম প্রহরে শুধু একরাশ উল্লাস, এই তো বড় হয়ে গেছি। এখন কেউ আমাকে ছোট বলবে না, আমি এবার নিজের পরিচয়ের খোঁজ করবো, প্রথম কটা বছর জুড়ে শুধুই এক রাশ রোমাঞ্চ, বদ্ধ ঘরে থাকার দিন শেষ- এবার জগতটাকে দেখবো চোখ খুলে,প্রানের স্ফূর্তি দেখবো,অনুভবে, সম্ভ্রমে, তেজে, শিরার উষ্ণস্রোতে প্রতিবাদী কন্ঠধ্বনি, বেপরোয়া কিছুক্ষণ, কিছু দিন। তারপর, আবেগের জায়গাটা প্রজ্ঞা নিয়ে যায়, ঐ প্রথম প্রহরের উল্লাসটা ক্ষনিকের ভাটায় নেমে যায়, বাবার ছায়াতল কেমন ছিল, মনে পড়ে যায়।
Source
মনে পড়ে কোনো এক সন্ধ্যায়, ইস্কুলের ফাঁকিবাজিতে গণিতের পরীক্ষায় ডাব্বা পাওয়া, অঙ্কের খাতা জুড়ে কেবল গরুর ছবি, বাংলার খাতাটার পৃষ্ঠা ভাঁজ হয়ে কাগুজে এরোপ্লেন হয়ে গেছে,ইংরেজির মাস্টারমশাইয়ের মোটা ভুঁড়িটার বদৌলতে গমগমে দুপুরে শেক্সপিয়ার পড়তে দিয়ে তন্দ্রায় কাত, আর ঐ বালকের জানালা দিয়ে ছোঁড়া উড়ুক্কু জাহাজটি পন্ডিতের টাকওয়ালা মাথায় টঙ্কার দেয়া - তৎক্ষনাৎ সম্বিত ফিরে পাওয়া, তার নালিশ বাবার কানে যাওয়া।
গুটিকতক নালিশ জমা হয়ে যখন কতকটা ভারি হলো, তখন সন্ধ্যায় শেষে কিছুটা ঝটিকা তুফান বয়ে যাওয়া, শাষনের ভীড়ে দুষ্টুমির লাগাম টানা- আঠারোর পর মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে।
একসময় যৌবনের শেষে নতুন কোনো অভ্যাগত জুটে ভাগ্যে, তার সাথে নতুন ঘর বাঁধা, মা -বাবা তখন শুধু মঙ্গল কামনায় ব্যস্ত, বাবার চোখ রাঙানি আর দেখা যায় না, আর কেউ বলে না এটা করো না, ওটা করো, এদিকে কেন গেলে, যা ইচ্ছা করো, আমার মাথা খাও, এখন শুধুই স্বাধীন করে দেয়া। এখন ছেলে সম্পূর্ণ দায়িত্ব বুঝে নেয়া,সংসার কেমন দেখতে তার ফিরিস্তি দিয়ে বাবার অবসর গ্রহন। ছেলেটি ততদিনে বুঝে গেছে,মধ্য গগনের সূর্য এখন অস্তমিতের আমানত। এভাবে কোন একদিন বাবার বুক জড়িয়ে ধরা, সেই ছেলেবেলাটির পুনরাবৃত্তি।
মায়ের সাথে সারাটি বেলা লক্ষী বউটার সখ্যতা, শাশুড়ির সেবা করা, বাবার জন্য চা বানানো, স্বামীর বৈষয়িক হিসাব মেলানো, কত টাকা জমা পড়লো, কত গেলো তার পুরা হিসাব-নিরীক্ষনের দায়িত্বটা সাঁঝের বেলায় সেরে নেয়া। ছোট্টু টুমটুম সাহেবের গল্প শোনানোর আবদার রক্ষা করে চলা, এভাবেই তাদের দিন কেটে যায়।
সব সংসারই বোধহয় একদিন শেষ হয়, হয় নাকি? যেমন ভূমিকার ঘটা করে আয়োজন সারা হয়, তেমনি যবনিকাপাত - এতো প্রকৃতি ধর্ম। চিরকাল কিছু একরকম রয়ে যায় না, তারই নিয়মে সংসারের সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে যায়।
প্রৌঢ়ত্বের দিনগুলো গুনতে গুনতে যখন রোগটি বাসা বাঁধে, তারই নিরিখে ভাঙন শুরু, ভাঙাগড়ার খেলা - এইতো জীবন।
Source
বৃদ্ধকালটা শুধু প্রতিফলনে কেটে যায়, যেন জীবন নাটকে আর কিছু মঞ্চস্থ করবার নেই, যেন সন্ধ্যাবেলা নীড়ে ফেরা পাখির মতো সারাদিনের সমস্ত কলরব পোহাল, এ যেন উঠতি জোয়ারে বেলাশেষের ভাটা - যেমনি করে বাঁশির কোনো সুর এক সময় শ্রান্তুিতে মিলিয়ে যায়, গোধূলির সূর্য তার লালিমায় নিজের সমাপ্তি দেখে, বৈঠা ধরা নাবিক তার তরীর কিনারে তীরের দেখা পায়, এ সেই অনুভূতি -সারা মনপ্রান ভরিয়ে তোলে।
শুরুতে বলেছিলাম, চারিদিকে হৈ চৈ রব, মনে আছে আপনাদের? এবার তার গ্রন্থিমোচনের দিন ঘনিয়ে আসার পালা।
চারপাশের বেশবাস, কোলাহল, ঘটনা, প্রিয়জন, ব্যস্ততা সবই ঠিক আছে। শুধু ঘরের কোনে টেবিলের ওপর রাখা কুপিবাতিটার সলতে ধিকি ধিকি জ্বলছে। ফুরিয়ে এসেছে, তার অন্তরের সমস্ত জ্বালানি শেষের পথে, এবার যেকোন সময় ডুবে যাবে - চির অন্ধকারে, ঠিক যেই অন্ধকারে শুরুটা ছিল, কি নিখুঁত পুনরাবৃত্তি।
প্রথম সেদিন শুধু নিজের মধ্যে কান্নার রোল, চারদিকে খুশি,এবার প্রিয়জনের কান্না, চিরবিরহের বেদনার রোল, সে যে এক সমুদ্র পরিমান কষ্ট, বয়ে গেল যুগ থেকে যুগান্তরে, এভাবে মানব চরিত্রের শেষ, আমার গল্পটাও ফুরোল।
এ যেন একটি জীবন গল্পের সূচনা-সমাপ্তি। সুগভীর অন্ধকার থেকে যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন নিমগ্নতা, এ বুঝি একটি গল্পের শুরু এবং গল্পের ফুরানোর পাতায় এসে ক্ষণিকেই শেষ! মনে হচ্ছিলো যেন, কারো সম্পূর্ণ জীবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম কিংবা নিজেই নিজের অস্তিত্বের ভ্রমণে ব্যস্ত ছিলাম ক্ষণিকের জন্যে, গল্ল শেষ হতেই যেন ঘোর কেটে গেলো, না আমি হারাইনি, পুনরায় নিজেকে ফিরে পেয়েছি, এক নতুনরুপে।
ভালো ছিলো।🤍
ধন্যবাদ, ভাই।
গল্পটি হয়তো কোন একটি ব্যাক্তির নিজস্ব একক জীবনের সংক্ষিপ্ত রূপ, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সবার অস্তিস্তের মধ্যেই এর প্রতিফলন রয়েছে।
একেবারে মৌলিক জিনিসে পৌঁছে গেলেন, ভালো লাগছে এই ভেবে যে, গল্পটির চিরায়ত দিকটা ধরতে পেরেছেন।, 👍
হা হা। বেশিক্ষণ হারিয়ে যাওয়া ভালো নয়, তাহলে বাস্তবে ফিরতে পারবেনা না,😀।
গল্পটি ইন্দ্রিয় সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ৷ 👍💝
ধন্যবাদ। ভাই 🤍