পাড়া বা মহল্লা হচ্ছে বাংালী জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামের ও শহরের পাড়ার পরিবেশ ভিন্ন রকমের। গ্রামে যেখানে মানুষের মধ্যে অনেক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান অন্যদিকে শহরে একই বয়সের কিছু লোকের মধ্যে শুধুমাত্র সম্পর্কের বন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়। আমি যেহেতু বড় হয়েছি গ্রামে সেহেতু গ্রামে পেয়েছি অসম্ভব সুন্দর আন্তরিক পাড়া-মহল্লা। গ্রামের পাড়াগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং আয়োজনে সবাই সম্মিলিত হয়ে আলোচনা করা হয় এবং কি কি কাজ কিভাবে করবে তা সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে দেয়া হয় । আমার মনে হয় না পৃথিবীর আর কোথাও এত সুন্দর আন্তরিক এবং সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান। গ্রামে কেউ মারা গেলে কিংবা কেউ বিপদে পড়লে লোকজন ছুটে আসে তৎক্ষণাৎ। আমি এরকম ও দেখেছি যেখানে গ্রামের যখন ডাকাত আক্রমণ করে সবাই রাতে তাদের নিজস্ব লাঠি অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে আসে তার প্রতিরোধ করতে।
মহল্লা এক নিবিড় বন্ধনের নামঃ
বন্ধন গুলো খুজে পাওয়া যায় যখন কেউ বিপদে পড়ে । ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি যখনই আমাদের মহল্লায় কেউ কোনো অসুবিধায় পড়ে সবাই একসাথে এগিয়ে আসে তার সাহায্য-সহযোগিতায় । উদাহরণস্বরূপ যখন গরিব কোন মহল্লাবাসী তার মেয়েকে বিয়ে দিতে কষ্ট হতো তখন দেখতাম মহল্লার সব প্রতিনিধিরা এবং বয়স্করা একত্রিত হতেন কিভাবে তাকে কি রকম সহযোগিতা করে এই কাজটি যত ভাবে সম্পন্ন করা যায় । কারো কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি হলে তার চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর জন্য মহল্লাবাসী প্রত্যেকের ঘর থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে এমনকি পাশের গ্রাম থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করে দিতো । এরকম বন্ধন আর আন্তরিকতা দেখতে দেখতে যেহেতু বড় হয়েছে সেহেতু মহল্লার মাঝে আন্তরিকতা ও বন্ধনটা খুঁজে পাই। আরো দেখেছি মহল্লার কাউকে অন্য কোন মহল্লার কেউ আঘাত করলে বা অন্যায় ভাবে মারধর করলে সেটার প্রতিবাদ জানানোর জন্য সবাই এক হয়ে তার পক্ষ নিয়ে এগিয়ে যেত । এটাই হচ্ছে বন্ধন । জীবন সংক্ষিপ্ত আর এই সংক্ষিপ্ত জীবনে একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা বন্ধন ভালোবাসা এটাই হচ্ছে উপহার । আর এই উপহার পাওয়ার জন্য মহল্লার কোনো জুড়ি নেই কারণ মহল্লা মানে হচ্ছে সমাজ আর এক সমাজে সবাই সবার প্রতি আন্তরিক থাকাটাই হচ্ছে সমাজের নিয়ম ।
মহল্লা এক ভালোবাসার নামঃ
যেকোনো দুর্যোগে কিংবা অসুবিধায় মহল্লা বাসীরা এক হয়ে কাজ করে থাকে । শিশুদের মধ্যে যেমন রয়েছে মিল খেলাধুলার ক্ষেত্রে তেমনি বড়দের সাথে ও শিশুদের রয়েছে গভীর সম্পর্ক । এই ভালোবাসার প্রকাশ পায় যখন মহল্লাবাসী একসাথে কোন বিষয়কে মোকাবেলা করতে যায় । ছোটবেলায় যখন গ্রামের হয়ে খেলা দেখতে যেতাম তখন মহল্লার খেলোয়াড়দের কে সবাই মিলে সাপোর্ট করা ছিল অন্যতম মজার একটি ব্যাপার । বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবাই এক হয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র যাওয়া এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে মেরামতের কাজ একসাথে করার এক অনন্য ভালোবাসার উদাহরণ । এই ভালোবাসা বহুগুণ বেড়ে যায় যখন রমজান মাস আসে কারণ রমজান মাসে সবাইকে একসাথে পাওয়া যায় মসজিদে কিংবা বাড়িতে। একসাথে সেহরির জন্য রান্না করা ও একসাথে ইফতার করা কিংবা একসাথে নামাজ আদায় করা সবকিছু মিলিয়ে এ এক অনন্য সুন্দর আয়োজন । ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে ঈদের দিনগুলোতে ।
মহল্লা এক আড্ডাখানাঃ
মহল্লাতে আড্ডা প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে । আড্ডার কোন সময় নেই, বয়স নেই, স্থান নেই । আগেকার দিনে অনেক ফসল ছিল যখন সবাই কৃষি কাজে খুব ব্যস্ত থাকত তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা রাতে আড্ডা দিতে আসত । সামান্য বিনোদন হিসেবে ছিল ভিসিআর টিভি । কিন্তু আজ আড্ডার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মোবাইল ফোন, রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ইত্যাদি । বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন বিভিন্ন বয়সের মানুষের মাঝে আড্ডার প্রবণতা মধ্যে একটা বন্ধন তৈরিতে সহযোগিতা করে যদিও তা মাঝে মাঝে ঝগড়া রূপ নেয় । যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব সেহেতু সমাজে বসবাস করতে গেলে তাকে অন্যদের সাথে আড্ডা দিয়েই জীবন অতিক্রম করতে হয় । সেজন্যই মানুষ ঘরে একা থাকতে পারে না । তাই পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে বিভিন্ন জনের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে মহল্লাবাসীর অন্যতম প্রধান সময় পার করার খোরাক । আমাদের মহল্লার বেশিরভাগ মানুষই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল এবং কিছু মানুষ প্রবাসী । ছোটবেলায় মহল্লার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকাজের নির্ভরশীল ছিল এবং বাড়িতেই থাকতো তাই বেশি পরিমাণে মানুষ দেখা যেত কিন্তু এখন পুরুষ মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে কারণ তারা মহল্লার বাইরে অর্থাৎ প্রবাসে রয়েছে । আবার এদিকে চলে এসেছে মোবাইল তাই এখনকার আড্ডাগুলো আগের আড্ডার মত এত জমজমাট হয়না । ভার্চুয়াল জগতে এখনকার ছেলেমেয়েরা সময় অতিক্রম করতে চায়
Source : Image by Gerd Altmann from Pixabay
মহল্লার পরিবর্তনঃ
আমার মহল্লা টা খুব দ্রুতই বদলে যাচ্ছে । পরিবর্তনটা একেবারে চোখের সামনে । গত ২০/২৫ বছরের মধ্যে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা অকল্পনীয় । ছোটবেলায় যাদেরকে দেখেছি তাদের মধ্যে কোন অন্তঃকলহ ছিলনা ছিল না। না ছিল মনে কোন প্যাচ । একে অন্যকে পুলিশ কিংবা আইনের মাধ্যমে শায়েস্তা করার কথা কল্পনাও করতে পারতো না । আনন্দ ছিল খেলাধুলা এবং একসাথে ঘুরাঘুরির মধ্যে । কিন্তু বর্তমানে সে আনন্দ গুলোকে কেড়ে নিয়েছে ঘরে ঘরে থাকা টেলিভিশনের হিন্দি সিরিয়াল । কাজেই বন্ধনগুলো আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে কারণ সবাই সবার ঘরে থাকতে পছন্দ করছে । সময় কাটিয়ে দিচ্ছে মোবাইল দিয়েই । আর শিখে ফেলছে নোংরা রাজনীতি যার হাতিয়ার হিসেবে একে অন্যকে পিষ্ট করে চলছে করছে জুলুম । এতে করে সমাজে বয়সকে দেরকে মান্য করার যে প্রবণতা এবং এক হয়ে কিছু করার ইচ্ছা তা অনেকটাই আজ মলিন । এই সময়টা আগে ছিল না যা এখন দেখতে পাচ্ছি ও হচ্ছে । একে অন্যের সাথে মারামারি করার যেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা আগে কল্পনাও করা যেত না বরং মানুষ এসব করার কথা চিন্তাও করতো না কেননা সবাই সবার মত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত । এটা বলা হয়ে থাকে যে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা । বৈদেশিক অর্থ পেয়ে এবং কাজবিহীন থেকে মানুষের মাঝে এই প্রবৃত্তিগুলো তৈরি হচ্ছে বলে আমি মনে করি । একটা টিভিতে সবাই অনেক অপেক্ষা করে ফুটবল খেলা দেখা কিংবা কোন বাংলা সিনেমা দেখা কিংবা একসাথে অন্য কোন পাড়ার বিপক্ষে খেলতে যাওয়া আজ মোটেও চোখে পড়বে না ।
শেষকথাঃ
জীবন গতিশীল তাই সে এগিয়ে যাবে তার নিজস্ব গতিতেই । সমাজ পারা কিংবা মহল্লা এই গতির বাইরে নয় । জীবনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আসবে মহল্লা, পাড়া ও সমাজে । তবে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা একেবারেই অকল্পনীয় ও অকাম্য । প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে একথা সত্য কিন্তু এর মধ্যেও আমরা চাইলে আমাদের বন্ধন গুলোকে, ভালোবাসা গুলোকে, আবেগগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারতাম মহল্লার সবার সাথে আগের মতো সময় কাটিয়ে । ছোটবেলায় আমাদের বয়সে যারা ছিল তাদের সংখ্যা ছিল অনেক আমরা ক্রিকেট খেলতাম, ফুটবল খেলতাম, হাডুডু খেলতাম আরো নানা রকম খেলা খেলতাম মহল্লার সবার সাথে । কিন্তু এখন এই খেলা গুলো আর দেখা যায় না দেখা যাবে ও না । তাই সমাজের এই পরিবর্তনটা খুবই আশঙ্কাজনক । এখন যেমন সমাজে যারা নেতৃত্ব দেয় তাদেরকে অনেকে মান্য করতে চায়না ভবিষ্যতে এই প্রজন্মের দ্বারা এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে যাবে । আমরা নেতিবাচক এই ভাবনাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে চাই। চাই আমাদের মহল্লার আবার আগের অবস্থায় আনন্দঘন পরিবেশ নিয়ে বেঁচে থাকুক । আমরা এই সমাজেই থাকবো এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করবো তাই আমার মহল্লা এবং সকল মহল্লাবাসী কে আহ্বান জানাবো আসুন আমরা সবাই মিলে এক হয়ে মহল্লার পরিবেশটাকে ভালো ও আনন্দঘন রাখি, রেষারেষি থেকে দূরে রাখি । আর এর মধ্য দিয়েই মহল্লাতে ফিরে আসবে আগের মত আবেগঘন সেই অনাবিল আনন্দ আর আনন্দ । রাজনীতি করা মানুষের অধিকার এবং রাজনীতি করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নোংরা এবং দুষ্টু রাজনীতি থেকে আমরা আসুন বিরত থাকি কারণ আমরা যার উপরে জুলুম করি না কেন রাজনৈতিক প্রভাবের বলে কিংবা অন্য কোন উপায় সে কিন্তু আমারই গোত্রের কিংবা প্রতিবেশি কিংবা মহল্লাবাসী । পাঁচ / ছয় পুরুষ উপরে গেলে পাওয়া যাবে যে সে আমারই ভাই বা চাচা । যদিও আজকে কথাগুলো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে তারপরও মহল্লা নিয়ে আনন্দঘন স্মৃতিগুলো ছোটবেলার স্মৃতি হিসেবে বলা যায় কারণ বর্তমান মহল্লার স্মৃতিগুলো কখনোই সেই আগের স্মৃতি নয় যা কিনা এখানে বর্ণনা দিব । সবাইকে আমার ব্লগ পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ । আসুন এই কঠিন সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকি এবং সচেতন থাকি।
আমি একটি দুর্দান্ত সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করার জন্য #bdcommunity টিমকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিডিকমিনিউটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং হাইভ প্লাটফর্মে প্রভাব বিস্তার করছে। আমি এই সম্প্রদায়ের সদস্য হতে পেরে খুব আনন্দিত। এই সম্প্রদায়ের স্থানীয় হওয়ার কারণে আমি বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বিষয়ই উপভোগ করতে পারি।
আমি কেঃ
আমি বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রভাষক এবং সদ্য বিবাহিত স্বামী। আমি আমার চিন্তাভাবনা এবং ধারণাগুলি আমার বন্ধুদের এবং সম্প্রদায়ের সাথে ভাগ করে নিতে ভালোবাসি। আমি এখন পর্যন্ত ইউটিউব, ডিটিউব ইত্যাদিতে আমি যা কিছু শিখেছি তা প্রকাশ করতে চাই, আমি টেক্সটাইল, আর্নিং এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কিত vlogs ব্যাখ্যা করি। আমি প্রাকৃতিক ফটোগ্রাফি ক্যাপচার করতে ভালোবাসি। আমি সর্বদা একজন শিক্ষানবিস এবং ব্লকচেইনের সাথে চাঁদে পৌঁছতে এখানে ব্লকচেইনে বিশাল সম্প্রদায় তৈরি করতে চাই।|
Upvote, Resteem and Follow me on hive @engrsayful
Find me on social media
Follow me on DTube
Follow me on Youtube
Follow me on ThreeSpeak
Follow me on Facebook
Follow me on Twitter
সুন্দর লিখেছেন ভাই।
thanks a lot for your appreciating comments
WElcome bro....❤
ভালো লিখেছেন। আশা করি কন্টেস্টে প্রথম হবার পথে আছেন।