বেশ বড় আর মোটামুটি ভারী একটা বাক্স কুরিয়ারওয়ালারা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
এক প্রকার জোর করেই প্রাপক কে সেটার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করছি।
ওটা কোলে নিয়ে বাড়িতে এলাম।
ঘরে ঢুকে বিছানার উপর রেখে দম নিয়ে বক্সটার দিকে তাকালাম।
জার্মানি থেকে আসা কাগজের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে অন্তর্দ্বন্দের এক বিশাল যুদ্ধে লিপ্ত হলাম আমি আমার নিজের সাথে।
কারণ তখন অনির্বাণের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ বেশ কিছুদিন ধরে যেটা চালু হবার কোনো সম্ভাবনা "ছিল না" কয়েক মুহূর্ত আগেও।
স্মৃতি নাকি যত সময় যায় তত ঝাপসা হয়ে আসে।
কিন্তু আমার এই যে এখন লিখতে বসেও হৃদয়ে অনুভব করতে পুরোপুরি না পারলেও স্মৃতিতে পারছি কেমন লেগেছিলো সেই মুহূর্তে।
তখনকার দিনে বেশীরভাগ ছেলদের ফ্যাসিনেশন ছিলো কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মেয়ে। আমি জানিনা কেনো, কিন্তু আমার বই পড়ার পাশাপাশি আনিমে ভক্ত হওয়া (Anime- Japanese tv series) বা রক-মেটাল গানের অনুরক্ত হওয়াটাকে অনেকে বাড়াবাড়ি রকম আহ্লাদিত হতো।
মানে এমনও অনেকবার শুনতে হয়েছে যে "তোমার প্রেমে পড়েছি কারণ তুমি অমুক ধরণের গান শোনো! বা আনিমে দেখো! বা বই পড়ো!" সেসব ছেলেমানুষী কথকতা মনে পড়লে হাসি আসে এখনো!
তো অনির্বাণের সাথে আমার পরিচয়ের কারণও ছিলো এরকম গতানুগতিক শুরু দিয়ে। আমি জানিনা মেয়েদের কি আদল সেসময়ের ছেলেদের মনে আঁকা ছিল, আমার এই খুব স্বাভাবিক পছন্দের ব্যাপারগুলোকে তারা দেবীত্বের পর্যায়ে নিয়ে যেত। বলছি ৮/১০ বছর আগের কথা।
যাকজ্ঞে যা বলছিলাম।
তো আমার জন্য আনিমে বা যেকোনো সিনেমা, টিভি সিরিজ দেখাটা খুব সহজ ছিলনা। ব্রডব্যান্ড, কম্পিউটার এসব আশেপাশেও ছিলনা।
কলেজ থেকে মাস শেষ একটা উপবৃত্তি পেতাম। চাতক পাখির মত সারামাস অপেক্ষা করতাম অই দিনটার জন্য।
সেটা দিয়ে কিছু বই কেনা হতো। বাকিটা দিয়ে কিনতাম ডিভিডি।
সুদূর চট্টগ্রামে একজন পড়ুয়ার খোঁজ পেয়েছিলাম যে স্বল্পমূল্য আমি যে আনিমে বা সিরিজ দেখতে চাই সেটা ডিভিডিতে রাইট করে আমাকে কুরিয়ার করে দিত।
যদিও ওভাবে আসলে পোষাত না।
তো যাহোক, ডিভিডি রাইট করিয়ে, রাজশাহীর গুটিকতক ভক্তদের এরওর কাছে ধরনা ধরে শেয়ার-ইট দিয়ে ঘন্টা ভরে আনিমে নিয়ে এভাবেই দিন যাচ্ছিল।
যদিও অনির্বাণ খুব একটা মিশুক গোছের না, তবে ওর সাথে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। আমাদের প্রচুর কমন প্ল্যাটফর্ম।
অনি অসাধারণ লিখতো।
(ওর বর্তমানের শোণিত উপাখ্যান ট্রিলজির উত্থান হয় তখনই। ক্যারেক্টার বিল্ডাপ শুরু করেছে তখন। ছোট ছোট চ্যাপ্টার লিখে আমাদের বলাপো গ্রুপে, দিত। সকলে মিলে আমরা পরামর্শ, উৎসাহ দিতাম)
কিন্তু ওর পরিচিতি নেই বলে খুব একটা সাড়া পেতোনা পাঠক মহল থেকে। আর আমি মোটামুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটা ছিলাম।
তো আমি চেষ্টা করতাম ওর এই প্রতিভার মার্কেটিং করতে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেউ আরবান ফ্যান্টাসি লিখছে ব্যাপারটা আমার কাছে মাত্রাতিরিক্ত রোমাঞ্চকর ছিলো।
আমি ওর প্লট শুনতাম,শুনতাম প্রবাস জীবনের গল্প,এর মাঝে হতো টুকটাক আমাদের গল্প করতাম।
অনির ইউনিভার্সিটি, পার্ট-টাইম জব আমার ক্লাস, ক্লিনিক্যাল সব মিলিয়ে ঝামেলার অন্ত ছিলনা। তারউপর আমাদের সময় ব্যবধান ছিল বড় একটা ঝামেলা।
তখনো মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আমাদের জীবনে আসেনি।
কিন্তু তবুও জার্মানি-বাংলাদেশ মিলিয়ে আমাদের মৈত্রী প্রচেষ্টায় সময় মিলিয়ে নিতাম একভাবে না আরেকভাবে।
কিন্তু আবেগ যখন বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে যেতে চায়, আমি সীমারেখা টানলাম নাগালের বাইরে যাবার আগেই।
এমন না যে আমারও হৃদয়ে কিঞ্চিৎ দোলা লাগেনি। যে ছেলেটা জার্মান ভাষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ, সে যখন জার্মান ভাষায় কবিতা লিখে উৎসর্গ করবে, কোন আয়রণ-মেইডেনের মন একটু হলেও গলবেনা। সবকিছু মিলিয়ে সেই তারুণ্যে অনিকে ভালো না লাগার কোনো কারণই নেই!
তার উপর কে যেনো বলেছিল-
লেখক/সাহিত্যিকদের প্রেমিকা হলে নাকি অমরত্ব অর্জন করা যায়। তাদের লেখায় বেঁচে থাকে প্রেমিকারা অনন্তকাল।
আমার বিশ্বাস ছিলো অনি আজ হোক বা কাল, চমৎকার একজন লেখক হবে। এমন মারাত্মক সব গল্পের প্লট, শুধু একটা বই প্রকাশ পেতে যা দেরী।
স্বভাবতই আমারও লোভ যে হয়েছে তা অনস্বীকার্য।
কিন্তু আমার যে বাঁধনে না জড়ানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিজের কাছে, সেটা থেকে বিচ্যুত হবার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না।
কষ্ট হলেও তাই আমাদের গল্পে ইতি টানবার দায়টা আমিই নিলাম।
কিন্তু তবুও...
তবুও অনির্বাণ সেই সুদূর জার্মানি থেকে কিছু পাঠাবে এটা কোনোভাবেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলনা।
সম্ভবতো ও দেশে থাকলে সাথে সাথেই ওর কাছে ফেরত দিয়ে দিতাম।
এমন এক জ্বালা যে কল করে এক প্রস্থ বকাঝকা করবো সে উপায়ও নেই! অনি কল করলেই একবল আমাদের যোগাযোগ হয়।
আন্দাজ করলাম যখন পাঠিয়েছে তখন আমাদের মাঝে যোগাযোগ ছিল।
অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব যুঝে সে প্যান্ডোরার বাক্স খুললাম।
হ্যারি ড্রেসডেনের অবয়বটাই সবকিছু আগে চোখে পড়লো।
সিরিজের প্রথম ৩টা বই (স্টর্ম ফ্রন্ট, ফুল মুন, গ্রেভ পেরিল)
তার পাশে পেলাম একটা ১-টেরা হার্ডডিস্ক (সে হার্ড ডিস্ক ভর্তি ছিল শ খানেক আনিমে, গান, সিনেমা।)
আর কয়েক বাক্স চকলেট।
আমি ওভাবেই বসে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম "এজন্যই কি এক্সট্রা আরেকটা পার্টটাইম জব করছিল!?"
এই জিনিসগুলা হয়তো খুব আহামরি কিছু শোনাবেনা এত বছর পর এই আধুনিক সময়ে।
কিন্তু সেই সময়টায় এই সমগ্র প্রচেষ্টাটা সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ১০১টা নীলপদ্ম এনে দেয়ার মতই ছিল।
আমি তখনই ফেইসবুক খুলে আনব্লক করে ওকে মেসেজ দিলাম কল দেবার জন্য।
প্রায় সাথে সাথেই এলো কলটা।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দারুণ লিখেছেন।
ধুর মিয়া। এইসব বাজারি-লেখার প্রশংসা করলে লজ্জা লাগবে।
কিন্তু ধন্যবাদ তবুও 😂