যাশোরের সাগরদাঁড়ি, কপোতাক্ষ, আর মধুসূদন দত্ত এক বেলা

in BDCommunitylast year (edited)

ফারদিন আপুর সাথে দেখা হলেই ট্যারা চোখে বলে "ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় তোমার আর হলোনা!"
২২'সাল যেয়ে ২৩ এলো।
আমার সুযোগ হলোনা।
শেষতক বলেছিলাম "ঈদের পরে হবে। কোন ঈদ সেটা জিজ্ঞেস করবেন না!"
আপু আরেকটা তীব্র ভষ্ম করে দেওয়া ট্যারা দৃষ্টি দিয়ে সেদিনের মত জেরা থেকে মুলতুবি নেয়।
কিন্তু সে আমার সহকর্মী কদিনই বা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়!
এদিকে আমারও সাপ্তাহিক ছুটিতে নানানা ব্যস্ততা আর ঝামেলায় কাটে।
উনাকে নিয়ে যাবার উপোযগী জায়গাও তেমন নেই।

উত্তর, পুর্ব ও পশ্চিম এবং দক্ষিণ বঙ্গে মোটামুটি আর তেমন কিছু বাকি নাই। সুতরাং যাওয়া জায়গায় আবার যাবার ইচ্ছে নেই।
দক্ষিণ বঙ্গের একটা পাশও (বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা) ঘুরে এসেছি বেশ আগে।
সুন্দরবনের এই পাশটায় বাকি থাকলো কেবল। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার জন্য চাই লম্বা ছুটি। এই অসুবিধার কারণে ওদিকটায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি আগে।
সরকারকে গালি দিলেও পদ্মা সেতুর কল্যাণে আমার ঘোরাঘুরিটা বেশ ভালোই হচ্ছে। সে কথা উঠতেই শৈল বললো, "এই আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে খুলনায়, ওখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারি"।
ব্যাস!

আর দেরি কিসের। আমার মতো গরিব মুসাফিরের হোটেল খরচ বেঁচে যাবে, এবং ধারনাক্রমে ঘরোয়া রান্না খাওয়া হবে, এর থেকে সুখের কথা আর কি হতে পারে। তো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, দুজনকে বগলদাবা করে এক ভোরে উঠে পড়লাম খুলনার বাসে।


Picsart_23-06-03_18-55-13-446.jpg সাইনবোর্ডটা দেখে Three Billboards সিনেমাটার কথা মনেপড়লো

সুপ্রিয় যেমন প্রচন্ড অমায়িক, সুপ্রিয়র বাড়িতে যেয়ে ওঁর বাবা-মা'কে দেখে বুঝলাম সে মধুর অমায়িকতার উৎস কোথা থেকে এসেছে।

সারারাত জেগে অফিস করে, এই লম্বা নির্ঘুম বাস যাত্রার পরে, কথা ছিল ঐদিনটা আরাম করে, খেয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় রূপসা ব্রিজ দেখেই ঐদিনের মতো ক্ষান্ত দেব। কিন্তু, বসে বসে হিসাব করলাম, মাঝে যেহেতু শুধু একটা দিন ছুটি থাকবে, সুতরাং যশোর যেতে চাইলে আজই যেতে হবে। সে কথা সংগীদের জানালে তার সোত্সাহেই রাজি হলো।
খুলনা পৌঁছে গেলাম ১২টার মাঝেই প্রায়। নেমেই মেসোর সাথে বাসায় যেয়ে স্নানাহার সেরেই আলস্য জেঁকে বসবার আগেই আমরা তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম যশোরের উদ্দেশ্যে।

IMG_20230615_043135.jpg

গন্তব্য মধুসূদন সাহেবের ভিটে বাড়ি দেখতে যাওয়া।

IMG_20230615_040713.jpg এই অংশটা দেখতে একদম হুবুহু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির মত লাগে।

এমন না যে, এটাতে কোনো আর্কিটেকচারাল শৈল্পিকতা আছে, তবে সাহিত্যিক টানেই যাওয়া।
সংরক্ষিত হয়েছে ভালোই। সে কালে এমন চমৎকার বাড়ি একদম গ্রামের ভেতরে বানানোটা জমিদারিত্বের ছাপ রেখেছে বৈকি।

যদিও হলুদের আবরণে ঢাকা বাড়িটা কি খেয়ালে এই রঙ করা তা জানা গেলো না।

ঘুরে ফিরে মধুসূদন সাহেবের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু চিহ্ন দেখলাম। কথা হলো সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত সংরক্ষণ কর্তা মোতাহের চাচার সাথে।
বললাম এই যে নিরালায়, সরকার নিয়োগ দিল, ভালো লাগে এখানে থাকতে।
বললেন, "বাড়িতো আমার এখানেই। সরকারি চাকরি, ২০ বছর ধরে আছি। ঝুটঝামেলা নেই, খারপ লাগেনা।"
তারপর শুধুলেন "কিসে পড়ি"
বললেম পড়াশুনার পাট চুকিয়েছি বেশ ক'বছর আগেই। চাকরি করি ঢাকায়। ছুটির দিনে বেড়াতে এলাম।
"সরকারি চাকরি?"
"না। বেসরকারী কোম্পানিতে।"
"এগুলারতো নিশ্চয়তা নেই। আজ আছে, কাল শেষ।"
বুঝলাম আর দশজন আটপৌরে বাঙালির মতো সরকারি চাকরির সোনার-হরিণ পোষ না মানানোর ব্যাপারটা উনারও বোধগম্য হলোনা।
হেসে বললাম, "এক জায়গায় নিশ্চয়তা খুঁজতে পচে মরবার চেয়ে, উড়ে বেড়ানো জীবনইতো কাম্য নয় কি!"
বোধহয় আমার মেকি অধ্যাত্বিকতা উনার মনঃপুত হলোনা, হাসলেন। টুকটাক গল্প বললেন আরো।

দেখলাম জীবনান্দের হাতের লেখা দারুন সুন্দর।
বাড়ির বাইরে আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় উনার কবিতা বা কবিতার অংশবিশেষ সাইনবোর্ডে লিখে সংরক্ষিত আছে।
ছোটবেলায় পড়া সেই রূপকথার কবির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে, তার রচিত কবিতা আওড়াতে অদ্ভুতই লাগলো।
বাড়ির আরেকটা পাশে একটা আলাদা ছোট ঘর আর তার পাশে বড়সড় একটা বাগান।


IMG_20230615_043217.jpg

ঘাসে ছাওয়া সে বাগানে যেয়ে শুয়ে পড়লাম কিছুক্ষন।
হঠাৎই প্রর্কৃতি প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য যেন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা ফেলতে লাগলো।
IMG_20230615_040859.jpg

বাগানের শীতল হাওয়ায়, ঘাসের চাদরে শুয়ে, হঠাৎ এই অনাহুত অতিথির আগমন আমার বেশ অপছন্দ হলেও, বৃষ্টি পাগল শৈলী বেশ আনন্দিত হলো।

IMG_20230615_040821.jpg

তার মাঝেই তার সব ঘুরেটুরে, বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে শৈলী বায়না ধরলো কপোতাক্ষ নদে যাবে। তখন প্রায় শেষ বিকেল। কপোতাক্ষ নদ কতদূরে এ সম্পর্কে কারো ধারণা নেই বলে আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু সে বায়না যাবেই। তার ধারণা যেহেতু মাইকেল দত্ত কপোতাক্ষের তীরে বসেই কবিতা লিখতো, সুতরাং বাড়ি থেকে নদের দূরত্ব খুব বেশি হবেনা।
IMG_20230615_040955.jpg

বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আশেপাশের দোকানে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, আসলেই খুব বেশি দূরে না।
যেহেতু এত ভেতরে সচারচর কেউ আসেনা, আমাদের অটোরিক্সা ভাড়া করেই আসতে হয়েছিল। এবং পরে সিদ্ধান্ত হলো, আবার এটিতে করেই মেইন রোডে ফায়ার যাব, লাগেতো দু'পয়সা বাড়িয়ে দেব ভাড়া, যদিও আমরা খুব হিসেবে করে ভ্রমণ করছি।
IMG_20230615_041040.jpg

সত্যিই একদম বাড়ির পাশেই ছিল সে নদ।
ওখানে যেয়ে নৌকা দেখেই লাফালাফি শৈলীর নৌকায় নদীতে ঘুরবে। হাতে সময় কম, ওদিকে ড্রাইভার সাহেব তারা দিচ্ছে, এদিকে ফারদিন আপু ভয় পাচ্ছে।
দুজনের কেউই সাঁতার জানেনা।
বললাম অসুবিধে নেই, নদীতে পড়ে গেলে, একজন আমার পা ধরবে, আর একজন আমার হাত।
তোমাদের টেনে নিয়ে আসবো। বোঝা গেলোনা, ভরষা পেলো কিনা তবে, আমাদের সাথে যেয়ে নৌকায় উঠলেন।
শাঁখের করাত হিসাবে আকাশেও মেঘ।
একটু আগে বৃষ্টির ছটা আগমনী তার বার্তা জানিয়ে গেলেও, ছই নৌকা দেখে আমারও খুব শখ হলো নৌকায় চড়বার।
ফারদিন আপু দুই দস্যির হাতে পরাজিত হয়ে, ভয়ে ভয়ে চড়ে বসলেন নৌকায়।

IMG_20230615_041132.jpg

নৌকায় উঠতেই আবারও সেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি।
যদিও আমার বৃষ্টি ভারী অপছন্দ তবুও আমি নৌকায় উঠে সবার আগে যেয়ে মাথায় চেপে বসলাম।
শৈলীত পায়ের কাছে ছৈয়ের সামনে এলোপাতাড়ি শুয়েই পড়লো।
ফারদিন আপু ভালো বাচ্চার মতন গুটিয়ে নৌকার ছৈয়ের ভেতরেই বসে দোয়া-দরূদ পড়তে থাকলেন।

ইতিহাস বলে, সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয় নাকি যশোরে। অথচ আমরা যেতে না যেতেই বৃষ্টি যেন মধুসূদনের হয়ে আতিথেয়তার আহ্বান জানালো।

IMG_20230615_041312.jpg

চারিদিকে নিস্তব্ধ, দুপাশে সবুজের শান বাঁধানো,
গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাস, শীতল,
তিনটি নিজেদের জগতে ডুবে থাকা নৌকার তিন প্রাণী,
আর নিদারুন কৌতূহলে তাদের অবলোকন করতে থাকা মাঝি,
সাথে সুর তুলেছে কপোতাক্ষের বুকে ক্রমশ ছন্দে চলতে থাকা বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ...
IMG_20230526_052635.jpg

ভাবলাম, এই পরিবেশ অমন কবির জন্ম না দিয়ে যাবে কই!
মাঝিকে শুধুলাম, "কেবল আপনারই নৌকা দেখলাম এখানে। এখানে নৌকা চালিয়ে পোষায়?"
বললেন, "একদম। দিন চলে যায়, অতটা লাগেনা। নিরালা মনে হলেও, যাত্রী যারা আসেন, তাতে দিনান্তপাত হয়েই যায়!"
ভাবলাম, "মিনিমালিস্টদের জীবন। কি সুখের।"

একসময় সেই মোহনীয় মুহূর্তেও টানতে হলো ইতি।
খুলনা ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
ওরা বললো, বাড়ি ফিরবার আগে খুলনা ইউনিভার্সিটিটা আজকে ঘুরে গেলেই পারি।
আমার শরীরে আর কুলালোনা, সুতরাং, প্রস্তাব দিলাম ওদের দুজনের ঘুরে আসবার জন্য। তারা আর তাতে রাজি হয়না।
পরে ফেরার পথে গরম গরম সিঙ্গাড়া, পাকোড়া, আর আলু পরোটা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

দরজা খুলে দিলেন মাসীমণি।
পরিচয় হয়নি তখনও উনার সাথে!
পরিচয় দেবার আগেই, তিনি জাদুকরের মতো বলে দিলেন, এই হচ্ছে মৌ, আর তুমি বোধহয় শৈলী! আর তুমি মা?
আপু বললেন "আমি ফারদিন।"

সারাদিন আপিস-কাচারী সেরে এলেও, মাসীমণির সে কি উদ্যোগ রান্না বান্নায়। সেই সুস্বাদু রান্নায় পেট ভরে খেয়ে, নরোম বিছানার স্পর্শ পেতেই আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে।

All the cotents are mine until it’s mentioned.

Sort:  

আপু bdvoter এর আপভোট পাওয়ার উপায় কি একটু বলবেন প্লিজ?

I have no clue brother. I get votes, and I don’t get votes as well.
You will find some of my amazing articles was not voted at all.
So only thing I can do is write as I cannoy help but writing and I am pretty good at it.
Keep writing quality content, be active, communicate with others and their post, interact in other communities, and that's all there it is.