ঈদাচার!

in BDCommunity15 days ago

লোকে অভিযোগ করছে যে,
"ফাল্গুন, বৈশাখ, পূজা, হোলি সবটাতে
তোমরা কত হৈ-হল্লা করো, উদযাপন করো,
ঈদ এলেই কেন শুধু তোমরা
ঘুমাবো, ঘুমাবো করে করো!"

হঠাৎ মনে হইলো অভিযোগটা আসলে সত্য। যেটা পরে ভাববার প্রয়াস পাইলাম যে, এমনটা আসলে কেন হয়।
সময় যত যাচ্ছে, আমাদের নষ্টালজিয়ার ঝুলি তত বড় হচ্ছে কিন্তু নতুন করে যে ঝুলিতে কিছু যোগ হচ্ছে না একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে।
কেন?
দেখা যাচ্ছে ২৪/২৫ বছর বয়সে এসে যেসব ব্যাপার নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগেছি, ২৭/২৮ বছর বয়সেও সেই জিনিসগুলা নিয়েই স্মৃতিকাতর হচ্ছি। সময় যত গড়িয়েছে তারপর রোমন্থনের জন্য নতুন কিছু তেমন যোগ হয়নি, হচ্ছেনা।
এখন আমাদের সপ্তাহ, মাসগুলা, মাসের শেষের বেতনের দিকে তাকিয়ে, আর বছরের বোনাসের দিকে তাকিয়েই পার হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যা কেবল সেটাই না। আমাদের সময়ের ২০/২২ বছর বয়সেতো অন্তত আমরা উপভোগ করেছি। আমার মতো ঘরকুনো মানুষও মার্কেটে গিয়ে ঈদের বাজার করেছে তাও আবার এক দফায় নয়, কয়েক দফায়। জবরদস্তি মা, চাচা-চাচীরা ধরে নিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ায় খুব একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করলেও, এখন সেই সময়গুলোই অবসরে হাসির খোরাক হয়।

মিড্-টুয়েন্টি বা তার পরে এসে উদযাপনে ভাটা পড়েছে, ক্যারিয়ার যখন জীবনের অংশ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের প্রজন্মের সেই সময়টাও যেন চারণের স্মৃতি নাই।
মনে হয় যেনো, ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের শেষ ভালো সময়টা আমাদের প্রজন্মের সাথে সাথে বুড়িয়ে গ্যাছে!

মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নতির সাথে সাথে টাকা পয়সার চাহিদা সম্পর্ক, ভালোবাসা, বন্ধুত্বের দাম কমে যাচ্ছে। অথবা কমে যাচ্ছে না বলে বলা যায়, প্রায়োরিটি লিস্টের নিচে পড়ে যাচ্ছে।

অন্য উদযাপনগুলার কথা বলতে গেলে, এগুলা সবই বেশ বহির্মুখী উদযাপন।


1000018401.png
দুর্গেশনন্দিনী!

মনে আছে এমনকি আমার মতো অন্তর্মুখী মানুষও এই গত দূর্গা পূজায় আমি শাড়িটাড়ি জড়িয়ে, আলতা-চুড়ি পরে সেজেগুজে দেবী দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে যেয়ে দেখি আবাল, বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই সেজেগুজে এসেছে বিভিন্ন মণ্ডপে। দেবী দর্শন শেষে পরিবারের সকলে মিলে খাচ্ছে যাচ্ছে,ঘুরছে ফিরছে, হাসছে, গল্প করছে। আমি এর আগে পূজার উদযাপন ওভাবে দেখিনি। ওদের সে উদযাপনটা দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। বিশেষ করে মহিলারা দিনান্ত রান্নাঘরেই পার করে না দেবার পরিবর্তে সেজেগুজে সকলে মিলেই উদযাপনের ব্যাপারটা আমার বেশ লেগেছিলো।
খেয়াল করে দেখলে বুঝবেন,
মূলত ফাল্গুন, বৈশাখ, যেসব আমাদের সাংস্কৃতিক উদযাপন, হোলি, পূজা যেসব হিন্দু ধর্মের উদযাপন, এই সবগুলোই বহির্মুখীভাবে উদযাপিত হয়। চারিদিকে একটা উৎসবের আমেজ থাকে। যেমনটা আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর (ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি) উদযাপনের ক্ষেত্রে হয়।

কিন্তু আমাদের ঈদের উদযাপনের আঙ্গিকটি ভিন্ন।
ঐতিহ্যগত ভাবেই দেখে এসেছি, মা জাতির রান্নাঘরেই আর অতিথি আপ্যায়ন করেই পার করে দিয়েছে দিনটি। তবে আমার মনে হয়েছে, উনাদের তৃপ্তি ওখানেই। অন্য সবাইকে রেঁধে বেড়ে খাইয়ে এই বান্দাদের তৃপ্তি হতো।

ইদানীং অনুভব করি, আমাদের ঈদের উদযাপনটা সময়ের সাথে সাথে বেশ ঘরোয়া হয়ে গ্যাছে আমায় দেখেছি। ছোটবেলায় সপ্তাহব্যাপী যে উদযাপন সেটা আর দেখিনা এখন। একদিনেই ঈদ শেষ। যদিও অন্য জেলার খবর জানিনা তবে চট্টগ্রামে জিনিসটা একেবারে প্রচন্ড নিয়মতান্ত্রিক।
ঈদের দিনে সকল প্রতিবেশীর ঘরে গিয়ে সালাম করে সেমাই খেয়ে আসতে হবে।
তার পরেরদিন যেতে হবে ফার্স্ট-ব্লাড আত্মীয়দের বাসায়। এরকম রোজারমাসে বসে আমাদের তালিকা সাজাতে হতো যে কে, কার বাসায়, কোনদিন যাবে। এবং অপরপক্ষের সাথে তা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হতো!

ঈদটা একটা উপলক্ষ হতো সারাবছর নানান ঝামেলা বা ব্যস্ততায় যেসব কাছের মানুষদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতোনা, তাদের সাথে অন্তরঙ্গতার একটা মোক্ষম মুহূর্ত।

যেহেতু আবহমান বাংলায় মা/চাচী/খালা/ফুফু/মামীরা এভাবেই যাপিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আছে, তাঁরা এতেই তাঁদের একান্ত আনন্দ খুঁজে নিয়েছে।
তারপর যখন সেসব বহির্মুখী উদযাপন দেখি, তখন এখন মনে হয়, আচ্ছা সেই গতানুগতিক ঐতিহ্যের বাইরে যদি আমাদের উদযাপনটা হতো, তাহলে পর্দার আড়ালের সে মানুষগুলো কেমন বোধ করতো? তারাও কি একটু সিঁথি করে, চুল বেঁধে, নতুন কাপড় পরে স্বামী-সন্তানের হাত ধরে মেলায় যেতে বিষম আনন্দ পেতোনা? তারাও কি সারাবছর ঘরের খাবার খেয়ে কাটিয়ে, এরকম দারুন উপলক্ষে একটু বাহিরি-খাবার খেতে আপ্লুত হতোনা?

আবার প্রায় সকলেই আফসোস করে, ঈদের সে আমেজটা আর নাই। ঈদের আমেজের আসলে হয়েছে কী? আমার প্রশ্ন এইটা।
আমার বয়স বাড়ছে, উদযাপনে ভাটা পড়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমার সেই বয়সের আমিকে পূরণ করা এ প্রজন্মের তারা কোথায়!? তাদের উদযাপনইবা কোথায়!

কে জানে!
যাক সে অযথা আকাশ-কুসুম ভাবনা।
আপাতত ঈদ মোবারাক সবাইকে।
আশা করি কাছে দূরে যে যেখানেই ঈদ করছে, আমেজটা যেনো থাকে ষোলোআনা।

All the contents are mine until mentioned otherwise