বর্ষায় প্রকৃতির মায়াবী সাজ ও ছায়াময় নিত্য
‘রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/ কাজরি নাচিয়া চল, পুরুষ-নারী হরষে/ কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/ কুহু পাপিয়া ময়ুর বোলে/ মনের বনের মুকুল খোলে।’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষা প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন তার মনের রংতুলির আঁচড়ে।
রিমঝিম বৃষ্টির মিষ্টিমাখা সুর শুনতে কার না ভালো লাগে। বর্ষার দিনে টিনের চালে ঝাপুর ঝুপুর, গাছের ডালে টাপুর টুপুর, পুকুর জলে রিনিঝিনি বৃষ্টির ছন্দে উদাস হয় মন। প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। বর্ষা রানীর মিলন বার্তা বহে অহরহ, প্রকৃতি সৌন্দর্য্যময় রূপসজ্জায় সজ্জিত। যেন বাসর ঘর সাজিয়ে রেখেছে সজীব সবুজ ঘেরা বাংলার আনাচে কানাচে। প্রকৃতি নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথাই নেই। না ! নব প্রজন্ম যেন বুঝতে পারে বিশ্বের অন্যতম দেশ বাংলাদেশ ষড়ঋতুর ছয় ধারায় চলে।
ঋতুচক্রে বর্ষার স্থান ও সকল ঋতুকে শুভেচ্ছা বিনিময় ,
ঋতুচক্র বর্ষাকাল দ্বিতীয়। আষাঢ় ও শ্রাবণ-এ দু’মাস বর্ষাকাল। তবে এর ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ, নির্মল, সতেজ আর উজ্জ্বল করে তেমনি মানুষের মনকেও ধুয়ে মুছে করে পবিত্র। আবহমানকাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র্য সৌন্দর্য্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে উদারতায়। বর্ষা ও তার ফুল যেন বাংলার প্রকৃতির আত্মা; বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি মানুষের মনে রঙ লাগিয়ে আসছে। বর্ষা নামলেই হাত চলে যায় প্রিয়ার খোঁপায় আর চোখ চলে যায় জানালার ফাঁক দিয়ে।
বর্ষায় নানা ফুল ও ফলের আবির্ভাব ,
বর্ষার গাঢ় সবুজের সঙ্গে চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শাপলা, কদম, কেয়া, কলাবতী, পদ্ম, দোলনচাঁপা, সোনাপাতি (চন্দ্রপ্রভা), ঘাসফুল, পানাফুল, কলমী ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানি মরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাটা, কেন্দার এবং এছাড়া নানা রঙের অর্কিডসহ আরও অনেক ফুল। বর্ষার কোমলতা মানুষের হৃদয়কে যতটা ছুঁয়ে যায় বাংলার আর কোনো ঋতু এভাবে ততটা ছুঁতে পারে না। তাই বর্ষা বাংলার অনন্য ঋতু।
বর্ষায় গ্রাম ও শহরের মায়াবী পরিবেশ এবং নতুন সাজে বাংলাদেশ,
শহর থেকে গ্রামের মানুষ বর্ষাকে আরও বেশি উপভোগ করে। গ্রামের কাদাময় পথঘাটে, কৃষকের ক্ষেতে কিংবা মাঠে গ্রামের শিশু-কিশোররা কাদা মেখে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে। পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করে বৃষ্টিকে উপভোগ করে। তবে এ সময় পশুপাখির মধ্যে কোনো চঞ্চলতা দেখা যায় না। তারা চোখ বন্ধ করে গাছের ডালে বৃষ্টিবিলাসে মত্ত থাকে। বরষায় আকাশভাঙা বারিধারায় কানায় কানায় ভরে ওঠে নদ-নদী, পুকুর-নালা, হাওর-বাঁওড়সহ ছোট-বড় জলাশয়। মনের সুখে ডাকে ব্যাঙ। বৌ-ঝিরা এ সময় ঘরে বসে নকশি কাঁথা সেলাই করে। সুঁচ আর হাতের জাদুতে হেসে ওঠে সুন্দর সুন্দর নকশীকাঁথা। বর্ষার মাঠে সবুজ ধানের শিষগুলো দুলতে থাকে আর বর্ষার রূপ কীর্তন গাইতে থাকে। ছোট ছোট খাল-বিলে শাপলা ফুটে হাসতে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা শালুক কুড়ায় ডুবাইয়ে আর শাপলা তুলে নৌকায় করে। উদাস করা পল্লীবধূ নৌকায় ঘোমটা পরা রাঙামুখ টেনে ছই নৌকায় বাপের বাড়ি নাইয়র যায়। আর ফিরে ফিরে চায় ফেলে আসা পথ পানে। পাল তোলা নৌকা কল কল করে। চলতে থাকে আপন মনে। আর মাঝি গান গায়।
গ্রামের মতো শহরে বর্ষার সৌন্দর্য খুব একটা ফুটে ওঠে না। তবুও ইট-পাথরে ঘেরা শহুরে লোকজনও বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঝুম বৃষ্টিতে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় বর্ষার পরশ পেতে। কেউ ছাদে উঠে বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে জুড়িয়ে নেয় দেহ-মন। শহরে থাকা দিনমজুরদের কষ্টের সীমা থাকে না বৃষ্টিতে। বিশেষ করে নগরে রাস্তায় বের হওয়া অনেক সময়ে চরম দুর্ভোগই নিয়ে আসে। গ্রামাঞ্চলেও অনেক সময়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তবে বর্ষা নিয়ে যাই চলুক আর ঘটুক প্রকৃতির গভীর আহ্বান ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় করেই চলছে বাঙালি মনন।
বর্ষার পানিতে ছোট বাচ্চা ও পাখিদের আনন্দময় খেলা,
ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টিতে একসময় ক্ষেত-পাথার ডুবে যায়। থৈ থৈ পানি চারিদিকে। যেন নতুন সমুদ্র জেগেছে গ্রামজুড়ে। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে মেতে ওঠে দুরন্ত কিশোরের দল। ঝাঁপ দেয় পানিতে, ডুব সাঁতারে হার মানায় পানকৌড়িকেও। কেউ কেউ গাছে চড়ে লাফ দেয় দীঘির পানিতে। চারিদিকে থৈ থৈ পানির ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলে বাইচের নৌকা। গ্রাম বাংলার মানুষের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম নৌকা বাইচের আয়োজন থাকে পুরো বর্ষাজুড়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে বেশ ভালোই লাগে। এক যুগ আগেও এ সময় নানী-দাদিরা গল্পের ঝুলি খুলে শোনাতেন নাতি নাতনীদের। রূপকথার রাজ্য, দৈত্য-দানব-ডাইনী বুড়ি আর রাক্ষসের গল্প।
বর্ষার প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগও সৃষ্টি হয়। সারা দেশে ঘনিয়ে আসা মেঘপুঞ্জ আর বৃষ্টির মধুর বিড়ম্বনা বর্ষার আগমন বার্তা অবশ্য দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। বর্ষার প্রকৃতিতে মহান স্রষ্টার অপরূপ সৌন্দর্য্যরে ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। বর্ষা প্রকৃতিকে যেমন সতেজ ও গতিময় করে তোলে, তেমনি মানুষের মনকে করে তোলে সহজ, সরল ও ছন্দময়। সৃষ্টিশীল চেতনাকে করে সুচারু ও তীক্ষ্ম। একজন ভাবুকের জন্য স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবার উপযুক্ত সময় এটা। বর্ষার নির্মেদ প্রকৃতি ফুরফুরে অনুভূতি সৃষ্টি করে প্রতিটি অন্তরে। উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগে তাড়িত করে সকলকে। বর্ষার প্রকৃতি উদার, প্রেম ও ভালোবাসার সরল অনুভূতি জাগ্রত করে।
কবির কণ্ঠে উচ্চারণ,
কবি কন্ঠে উচ্চারিত হয় অনন্য কবিতার পঙ্ক্তিমালা “আঁধারে ডুবিছে সবি/ কেবল হৃদয়ে হৃদি অনুভবি।”
এই বর্ষার আগমনে প্রেমিক কবিরাও আবহমানকাল ধরেই উচ্ছলিত-বিচলিত। বাঙালি অনেক বিখ্যাত কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। বাংলা ভাষার অমর কাব্য ‘মেঘদূত’-এর মহাকবি কালিদাস তো এই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই বিরোহী যক্ষ্ম মেঘকে দূত করে সুদূর দুর্গম কৈলাশ শিখরে পাঠিয়েছিলেন বিরোহিনী প্রিয়ার কাছে।
আষাঢ় নিয়ে তপস্যা,
এদিকে বাস্তবে আষাঢ় নিয়ে তপস্যা আর বিরহ যাই থাকুক, বর্ষাপ্রেমীদের মনেপ্রাণে বেজে উঠে কবি চৈতালি চৈতির অনবদ্য এই কবিতা- “আকাশ হতে আসা/ফোঁটা ফোঁটা শীতল জলে/এক ঝাঁক কদমের স্নান/এ যেন এক পূণ্য/ ভালোবাসা প্রাপ্তি।
বর্ষায় গ্রামবাংলায় নানারকম রূপে সজ্জিত হয। সারাবাংলা তখন রোড নতুন রূপে সেজেছে। তখন বিভিন্ন রকমের পাখি উড়ে বেড়ায়। মাছ খেয়ে বেড়ায় মাছরাঙ্গা পাখি গুলা পানকৌরি গুলা। বিভিন্ন রকমের পাখি, গ্রামের আপনি টাকা দামের চারদিক সাজে বিভিন্ন রঙে সজ্জিত বর্ষার বিকেল বেলা আকাশ টা দেখলে মনে হয় এই মুহূর্তে মনে হয় বৃষ্টি নামবে আকাশটা কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায় আবার একটু পরেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
বর্ষায় কিছু উপদেশ
১. বর্ষার পানিতে চারোদিকে প্লাবিত থাকে রাস্তাঘাট মাটগাট সব পানি টইটুম্বুর থাকে। তাই এ সময় বাচ্চাদেরকে একটু দেখে রাখতে হবে,চোখে চোখে রাখতে হবে যেন ওরা পানিতে না যায়।
২. বর্ষার পানিতে নির্ভর করে বন থেকে বনানী থেকে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত প্রাণী নেমে আসে এজন্য বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন কোন বিষাক্ত প্রাণী অর্থাৎ বিভিন্ন কিছু বসবাস না করতে পারে।
৩.বর্ষাকালে নিরাপদ পানির অনেক অভাব হয় এ জন্য প্রতিটি মানুষকে নলকূপের পানি হোক আর পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করার তা ফিটকিরি দিয়ে পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
Source
Direct translation without giving credit to the original author is Plagiarism.
Repeated plagiarism is considered fraud. Fraud is discouraged by the community and may result in the account being Blacklisted.
If you believe this comment is in error, please contact us in #appeals in Discord.
Please note that direct translations including attribution or source with no original content is considered spam.