কয়দিন ধরে আবারও সেই ভয়াবহ গরম। শুনছি প্রতি বছরই এভাবে কয়েক ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। গতকাল একটা কথা মনে হচ্ছিল, আমরা না হয় অর্ধেক জীবন পার করে দিয়ে এমন গরম দেখছি, আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকে তো জন্মের পর থেকেই এই গরম সহ্য করতে হবে! “Dune” এর মতন কাহিনী হয়তো আসলেই হতে যাচ্ছে!
তবে এই ভয়ংকর ঋতুটাতে একটা জিনিসের জন্য আমি প্রতিবার মুখিয়ে থাকি - ফুল! রাস্তায় বের হলেই কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালু, হিজল এই গাছগুলো যখনই দেখি মনটা জুড়ায় যায়! কিভাবে কিভাবে জানি গরমটাও কমে যায়! আর এই জিনিসটা প্রতিবারই হয়! একটা ফুলগাছ কিভাবে গরম কমায় দেয় এটা আসলেই ভেবে পাই না!
সব ফুলের মধ্যে আমি কৃষ্ণচূড়ার প্রতি একটু দুর্বল। আমার কাছে একটা জিনিস অদ্ভুত লাগে, সব কৃষ্ণচূড়া ফুলের রঙ কিন্তু এক না! কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া গাছ যদি পাশাপাশি থাকে তাহলে একটু খেয়াল করে দেখবেন। একেকটার রঙ একেকরকম হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। এই জিনিসটা সবথেকে বেশি বুঝা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে। এই সিজনটায় সেন্ট্রাল ফিল্ড থেকে মুক্তমঞ্চের দিকে তাকালেই দেখতে পারবেন কৃষ্ণচূড়ার লালের কত রকমের শেড হতে পারে! মনে হয় যেন চোখ ধাধিয়ে যায়!
![]() | ![]() | ![]() |
---|


সেদিন ইচ্ছা করেই প্রচন্ড রোদ মাথায় করে সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলাম, এসব ফুল দেখার উদ্দেশ্যে! ঢাকা শহরের জঞ্জালে তো আর গাছ দেখার উপায় নেই, ফুল তো দূরের কথা! তাই হুট করে যখন প্রকৃতি দেখার সুযোগ পাই তখন আর হাতছাড়া হতে দেই না! সব দেখে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে হয়েছিল এক মাসের জন্য এনার্জি বুস্ট হয়ে গেল! মাঝে মাঝে নিজের এই দিকটা দেখে অবাকই হই। কিভাবে শুধুমাত্র সবুজের দিকে তাকিয়েই মন ভাল হয়ে যায়!
আমার মতন প্রকৃতি প্রেমিক আরও একজন আছে, আমার মা। হয়তো তার জন্যই আমার এই স্বভাব তৈরি হয়েছে। আমার মতন আম্মুরও কৃষ্ণচূড়া খুব পছন্দের।
আমি বহু পেইন্টিং আর কমিশনের কাজ করলেও আম্মুর জন্য কখনও কিছু বানানো হয়নি। প্রায় ২/৩ বছর আগে একটা সাদা খাদির শাল এনে রেখেছিলাম, রঙ করে দিবো বলে। আমাকে অন্য কারোর কাজ করতে দেখলেই আম্মু বলতো, -আমারটা কবে করে দিবে? আমি প্রতিবারই করবো করবো বলতাম, কিন্তু সুযোগ আর পেতাম না। আমার প্ল্যান ছিল ভাল মতন সময় নিয়ে, যত্ন করে, অনেক ডিটেইলে আম্মুর কাজটা করবো। আমার দেরি দেখে আম্মু হতাশ হয়ে বলতো, "আর এঁকেছো তুমি আমার জন্য!"
এতদিন পর হুট করেই মনে হলো, আসলেই কাজটা ধরা উচিৎ। কি আঁকবো না আঁকবো অনেক ভাবার পর মনে হলো আমাদের দুইজনেরই পছন্দের ফুলটা আঁকি না কেন! যেই ভাবা সেই কাজ! নিয়ে বসলাম রঙের ব্যাগ আর সাথে সেই খাদির শাল।
কাপড়ে রঙ করতে গেলে যেই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি লাগে তা হলো ধৈর্য! উম, হয়তো খালি কাপড়ে না, যেকোনো কিছুতেই আঁকার জন্য ধৈর্য জিনিসটা খুব জরুরি। খালি হয়তো আঁকা না, যেকোনো ধরণের ক্রিয়েটিভ কাজ করার জন্যই আসলে ধৈর্য লাগে। যেভাবে রিলস দেখে আমাদের ধৈর্য দিন দিন কমছে, আর্টিস্টরা কিভাবে একটা প্রজেক্টে দিনের পর দিন নিজেদের আটকে রাখে ভাবি! আমার ক্ষেত্রেই তো! আগে যেমন সবকিছু ছেড়ে পুরো মনোযোগ দিয়ে একটা কাজ করতে পারতাম, এখন কিছুক্ষণ পর পরই ফোনের দিকে ডাইভার্ট হয়ে যাই।
আচ্ছা, এখন রঙ করার কাহিনীতে আসি। আমি কালার হিসেবে আক্রেমিন বেছে নিয়েছিলাম। বিশাল বড় কাপড়ে আসলে আক্রেমিন ছাড়া অন্য রঙ দিয়ে কাজ করলে পোষাবে না! বেজ হিসেবে গাছের ডালপালা দেয়ার পর মনে হলো কৃষ্ণচূড়ার কোন সেডটা দিলে বেশি ভালো লাগবে। যেহেতু ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা, তাই যত গাঢ় রঙ হবে তত জিনিসটা ফুটবে। তাই টকটকে লালরঙটাই বানিয়ে ফেললাম।
যারা কৃষ্ণচূড়া গাছ ভালো মতন দেখেছে তারা হয়তো বুঝবে আমার কাজের শুরুতেই একটা বড় ভুল করে ফেলেছি। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা ঠিক আসলে দেখতে এমন হয় না। একটু কঠিন করে বললে দ্বিপক্ষল পাতার গাছ আসলে আমি আঁকিনি। আমার আঁকাতে পাতাগুলো বেশ ঘন, কিন্তু আসলে কৃষ্ণচূড়ার পাতা খুব অল্প অল্প করে ছড়ানো। রেফারেন্স না দেখে মনে যেমন ছিল তেমন আঁকাতে পাতাগুলোতে গোলমাল বেঁধে গেছে। যদিও ভুলটা আমি না বললে হয়তো বুঝার উপায় ছিল না!
এই কাজ শেষ করতে প্রায় ২ দিনের মতন লেগে গিয়েছিল। কাপড়ে কাজ করলে এই একটা সমস্যা সেটা হলো সময়টা খুব বেশি লাগে। দুইদিনে হয়তো আমার দুইটা ক্যানভাস করা হয়ে যেতো। আমি একটু ভারি আর ভরাট কাজ করতে চেয়েছিলাম বলে সময়টা বেশি লেগেছিল।
কিন্তু এত সময় দেয়ার পর যেই জিনিসটা শেষমেশ হয়েছে তা দেখার মতন! আমি নিজের কাজের প্রশংসা সহজে করি না। কিছু জিনিস বানানোর পর খুঁতখুতে ভাবটা না চাইতেও চলে আসে। এটা ঠিক নেগেটিভ ভাবে না, আমি আসলে নিজের কাজের ক্ষেত্রে সমালোচনা করতে পছন্দ করি। কোন কাজ নিখুঁত বা নির্ভুল করার তাগিদে। এর জন্য প্রায়ই কাজ শেষ করার পর সন্তুষ্ট ভাবটা সহজে আসে না। কিন্তু যখন আসে তখন মনটা একদম ভরে যায়! এই কাজটা করে সেই রকমের অনুভূতিটা পাচ্ছি!
এখন আসল কথা বলি! আম্মুর কেমন লাগলো!? আম্মুর চেহারা হয়েছিল আসলে দেখার মতন। আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আম্মুকে কিছু না করে দেয়ার এতো দিনের রাগ-অভিমান সব এক পলকেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল।
আমরা আসলে সবার জন্যই সবকিছু করি কিন্তু মায়ের জন্য কিছু করার হলে তা ফেলে রাখি। সেই তাড়াটা থাকে না। কিন্তু আসলে মায়ের কাজটাই সবার আগে যে করা উচিত এটা ভুলে যাই। আমাদের ভেতরে এই উপলব্দিটা আল্লাহ যাতে বেশি করে বাড়িয়ে দেয় এটাই দোয়া করি! সব মা’ই ভালো থাকুক!
সত্যিই। এ বছরের গরম নিয়ে আর কিছু বলার মত ভাষা নেই। যদিও প্রতিবছর এই গরম বাড়তেই থাকবে, তবু আমাদেরকে প্রকৃতির ভালো দিকটি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে হবে।
আপনি একজন অসাধারণ আর্টিস্ট। একই সাথে মায়ের প্রতি আপনার ভালবাসা দেখে খুবই ভালো লাগলো।
হেহে, আর্টিস্ট হিসেবে দেখলে আমি এক্কেবারেই সাদামাটা! শখের বশে কিছু কাজ করা হয় এই যা! গরম কমানোর জন্য বেশি বেশি করে গাছ লাগান!! যাতে পুরো দেশটাই এমন নানা গাছে ভরে উঠতে পারে!
দারুণ কাজ করেছেন! ফুলের শেডের ব্লেন্ডটা অসাধারণ লাগছে।
এই ব্লেন্ডটা করতেই সবচেয়ে মজা লেগেছিল! সাটিস্ফাইং!😌