পোষা পাখি

in BDCommunity3 years ago

গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম।ছোটবেলা থেকে আমি ছিলাম ভীষণ ডানপিটে আর রগচটা।তাই সেই ছোটবেলা থেকে আমি ছিলাম বেশ স্বাধীনচেতা।মানে আমার পরিবারের কেউ আমার মতের বিরুদ্ধে যেতো না।আম্মার একটাই বানী ছিলো,জানা কথা ওর রাগ একটু বেশি ওকে রাগিয়ে দেওয়ার কি দরকার।আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে পাখি আমাকে খুব আকৃষ্ট করে।আমাদের বাঁশঝাড়ে অনেক পাখি ছিলো,যেমন ঘুঘু,দোয়েল,প্যাঁচা,বক ইত্যাদি।

ঘুঘু আর দোয়েল মাটিতে হেঁটে হেঁটে পোকামাকড় খেতো দুপুরবেলার দিকে,কারণ দুপুরবেলা বাঁশঝাড় নিরিবিলি থাকতো,গ্রামের মানুষ দুপুরবেলা বাঁশঝাড়ে যেতে ভয় পেতো।আমি তখন একা একা চুপিচুপি তাদের দেখতাম।তখন মোবাইল ফোন ছিলো না,ক্যামেরাও ছিলো না।আমি তখন দুই হাত দিয়ে ক্যামেরা বানিয়ে পাখিদের ছবি উঠানোর অভিনয় করতাম।আমি যেহেতু প্রতিদিনই এগুলো করতাম তাই পাখিরা আমাকে ভয় পেতো না।

এবার আসা যাক প্যাঁচার কথায়।গ্রামের মানুষ প্যাঁচাকে খুব ভয় পায়।প্যাঁচাকে দেখতে একটু ভয়ংকর,কেমন যেন ভুত ভুত একটা বেপার।প্যাঁচা যেহেতু নিশাচর প্রাণী তাই দিনেরবেলা ওরা বাঁশঝাড়ের অন্ধকার অংশ চুপচাপ বসে থাকতো।আমি যখন ওদের দেখার জন্য যেতাম ওরা গোলগোল চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে মাথাকে ঘুরাতো,আমাকে যেনো ভয় দেখাচ্ছে এমন একটা ভাব।আমিও উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে মাথা ঘুরাতে চেষ্টা করতাম।

আমাদের বাড়িতে ঘুঘু শিকারী আসলে আমি তাদের সাথে ঝগড়া করতাম,এইজন্য পরে আর আমাদের বাড়ির আশপাশে ঘুঘু শিকারী আসতো না।ওদের আমার উপর খুব রাগ ছিলো।ওদের আমি বলতে শুনেছি,"এখানে ঘুঘু থাকলে কোনো লাভ নাই, ঐ বিচ্ছু শিকার করতে দিবেনা।"

একদিন আমার এক চাচাতো ভাই আমাকে তিনটা দোয়েলের বাচ্চা এনে দিলো।বাচ্চাগুলো ছোট ছোট এখনও পাখনা গজায়নি।আম্মাকে বললাম একটা পিঞ্জিরা বানিয়ে দিতে।তখন আমার দাদু একটা পিঞ্জিরা বানিয়ে দিলো,আমি ওদের পোকা ধরে খাওয়ালাম।কিন্তু রাতে দুটি বাচ্চা মারা গেলো।তারপর যে একটা রইল সেটা আস্তে আস্তে বড় হয়েছে,হালকা উড়তে পারে,আমি এটার পাখায় রং লাগিয়ে দিলাম,যদি উড়ে যায় আমি যেন চিনতে পারি।একদিন কাপড় শুকাতে দেওয়ার তারে পিঞ্জিরাটা ঝুলিয়ে রাখলাম।সন্ধ্যায় যখন ঘরে নিতে গেলাম দেখি পাখিটা পিঞ্জিরার ভিতরে নেই।অনেক খুঁজেও আর পেলাম না।যেহেতু আমার পাখিটার পাখনা কালার করা ছিলো,তাই যেখানেই দোয়েল পাখি দেখতাম সেখানেই আমার পাখিটাকে খুঁজতাম।কিন্তু আর কোনো দিন পেলাম না।আজও আমি জানি না কি হয়েছিল সেদিন।

এর কিছুদিন পর আমাদের বাহির বাড়িতে দেখি একটা শালিকের বাচ্চা।বাচ্চাটা বেশ বড় কিন্তু একটা পা ভাঙা তাই উড়তে পারছে না।আমি পাখিটাকে এনে কাঁচা হলুদ বেঁটে ওর পায়ে বেধে দিলাম।কয়েক দিনের ভিতরে ওর পা ভালো হয়ে গেলো ও উড়তে পারে।ততদিনে পোষ মেনে নিয়েছে,আমি পড়তে বসলে আমার কাঁধে বসে থাকে।আমি যেখানে যাই,সেও সেখানেই যায়।বড়মামা একটা কাঁচা কিনে এনে দিলেন।আমি ওকে কথা শিখাতে চেষ্টা করতাম।ওর মধ্যে বাঁধ সাধল আমাদের প্রতিবেশিরা,প্রতিদিনই অভিযোগ নিয়ে আসে।একজন বলে তোর শালিক আমার ভাত নষ্ট করেছে,আরেকজন বলে আমার তরকারি।এমন করে আম্মা বিরক্ত হয়ে গেলো,কিন্তু আমি রেগে যাবো ভেবে কিছু বলে না।

একদিন বড়মামা এসে আমাকে ডেকে বললো,তুই পাখিটা কিছুদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে নিয়ে যা।তারপর ওর অভ্যাস ফিরে যাবে,তখন আর ঐসব বাড়িতে যাবে না।আমি বিশ্বাস করে দিয়েছিলাম।কিন্তু মামা আমার মামাতো ভাইকে পাখিটা দিয়ে বলেছিল,অনেক দূর ছেড়ে আসতে,যেন আর না ফিরতে পারে।আমাকে তখন বলা হয়েছিলো,পাখি হয়তো তোদের বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলো,তখন হারিয়ে গেছে।আমি কেঁদেছিলাম কিন্তু হারিয়ে গেছে কি আর করবো।তিন-চার বছর পর জেনেছিলাম,আমার শালিককে অনেক দূর ছেড়ে দিয়ে আসা হয়েছিলো।

শালিক পাখি হারিয়ে যাওয়ার পর আমার মাথায় আসলো ঘুঘু পাখি পোষবো।আমি জানি কোথায় কোথায় ঘুঘু পাখির বাসা আছে।আমাদের ঘরের পিছনে আম গাছে একটা ঘুঘু পাখির বাসা ছিলো।আমাকে দেখতে হবে ঘুঘু ডিম পেরেছে কিনা,কিন্তু ঘুঘু আমাকে দেখে নিলে হবেনা।তাই আমি প্রতিদিন সকাল থেকে লক্ষ্য রাখছি ঘুঘু কখন খাবারের জন্য বাহিরে যায়,ঘুঘু যখন বাহিরে যাচ্ছিল আমি ওর পিছনে গিয়ে দেখলাম কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে।যেদিন অনেক দূর গেলো সেদিন গাছে উঠলাম।দেখি দুইটা ডিম,এরপর চোখে চোখে রাখলাম।ঘুঘুর তিনটা বাচ্চা হলো,পরে বোধহয় আরেকটা ডিম পেরেছিলো।যখন বাচ্চা অল্প উড়তে শিখেছে তখন আমি আবার গাছে উঠলাম,তখন দুইটা বাচ্চা উড়ে চলে গেলো,ছোট বাচ্চাটা উড়তে গিয়ে নিচে পগে গেলো,আমি সেটাকে নিয়ে আসলাম।

ঘুঘুটা বড় হলো,প্রতিদিন সকালে বিকালে ডাকতো,শুনেছিলাম ঘুঘু পোষ মানে না,তাই কখনো এটাকে খুলে রাখতাম না।প্রতিদিন বিকালে পায়ে সুতা বেঁধে উড়তে দিতাম,ঘরের চালে গিয়ে বসতো।আবার আমি টান দিলে চলে আসতো।একদিন বিকালে অনেক উড়াউড়ি করার পর সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আমি ওকে খাঁচায় ঢুকিয়ে, খাঁচা নিয়ে ঘরে রাখলাম।একটু পর খেয়াল করলাম ঘুঘু খাঁচার কোনায় চুপ করে বসে আছে।আমি খাঁচা খুলে ঘুঘুটাকে বের করে আনলাম,পাখি এভাবেই বসে আছে,ঠোঁট মাটিতে লাগিয়ে ফেলেছে।

আমি চিৎকার করে বললাম,আম্মা আমার পাখি এমন করে কেনো।আম্মা বলে,পানি খাওয়া।আমি কেঁদে কেঁদে পানি খাওয়াচ্ছি।হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছি,কিন্তু পাখি মাটিতে পরে গেলো।ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো আমার চোখের সামনে,আমি কিছুই করতে পারলাম না।সেদিনের কথা মনে হলে,আজও আমার নিশ্বাস ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে যায়,চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।আমি আর কোনদিন পাখি পোষার কথা কল্পনাও করিনি।তবে আজও স্বপ্ন দেখি যদি কোনদিন আমার সামর্থ্য হয়,আমার বাড়ির পাশে একটা পাখির অভয়ারণ্য বানাবো।সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে কিচিরমিচির করে ফিরে আসবে শতশত পাখি।আমি দুচোখ ভরে দেখবো ওদের,কান জুড়াবে ওদের কিচিরমিচির শব্দে।

360_F_180831569_WxZNCyPqU6QH5wfjxuzcvknEopIY55DR.jpg

Sort:  

You have a good knowledge of birds. Love your explanation 👌. Keep growing on hive

Thanks for the compliment.

Congratulations @shaonashraf! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You distributed more than 300 upvotes.
Your next target is to reach 400 upvotes.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP