
আমার আম্মার তিন মেয়ে।সবার প্রথম দিদির জন্ম হয়।স্বাভাবিকভাবে গ্রামের মানুষজনের ছেলে বাচ্চা পছন্দ।বংশরক্ষার জন্য নাকি ছেলে থাকা অপরিহার্য।প্রথমবার মেয়ে হওয়াতে সবার হয়তো তেমন মন খারাপ হয় নি।কিন্তু পরেরবার যখন বাচ্চা হবে তখন হয়তো আবার ছেলের আশা করেছিলেন সবাই।কিন্তু আবার মেয়ে হলো।এরপর তৃতীয়বারের মতো আবার ছেলের আশা করে হয়তোবা মেয়ে দেখে তারা হতাশ হয়।মা-বাবা তো আর হতাশ হয় না,মা বাবার কাছে সন্তান সন্তানই হয়,সেটা ছেলে বা মেয়ে বলে কোনো পার্থক্য থাকে না।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য মানুষের সেটা আত্মীয়স্বজন বা সমাজের অন্য মানুষের।
কোনো জমি নিয়ে আব্বার সাথে ঝগড়া লাগলে, আব্বাকে আশপাশের অনেকেই নাকি বলতো,তোরতো কোনো ছেলে নাই তোর বংশের কোনো বাতিও নাই,তুই জমি নিয়ে আবার কথা বলতে আসিস।মানে ছেলে নাই,তাই নিজের জমির উপরও অধিকার দেখানো যাবে না!
"তিন তিনটা মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিবে" এসব চিন্তায় প্রতিবেশীদের ঘুম হতো না।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর ছোটোগল্প "সমাধান" এ দেখা যায়,নীহাররঞ্জন এর এক গ্রামের মেয়ের সাথে বিয়ে হয় তাদের একটি কুচ্ছিত মেয়ে হয় যার নাম রাখে বুচি।মেয়েটি ছিলো কালো,একটি চোখ ছোটো আরেকটি চোখ বড়,হাবাগোবা চেহারা,মুখ দিয়ে সারাক্ষণ লালা পরে।গ্রামের সবারই তার মেয়েকে নিয়ে লোক দেখানো চিন্তা। একদিন বুচিকে নিয়ে তার মা বাপের বাড়ি যায়,সেদিন চন্ডীপন্ডপে আলোচনায় বসে একজন বলতে লাগলো,নীহাররঞ্জন এর ভাগ্য অনেক খারাপ কারণ তার একটি মেয়ে হয়েছে তাও কিনা এতো কদাকার।একজন বলতে আরম্ভ করলো,এই মেয়েকে বিয়ে দিতে হলে নাকের জল চোখের জল নাকি এক হবে প্রচুর টাকা লাগবে।আরেকজন বলতে লাগলো শুধু টাকা হলেই বিয়ে দেওয়া যাবে না,লোকে টাকাও চায়, রুপও চায়,আর এই মেয়েরতো চেহারার বাজে অবস্থা।এমন সময় পত্রবাহক পত্র নিয়ে আসলো,বুচি মারা গেছে।
আহারে,ছোটো বাচ্চা সে বড় হবে বা বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত বাঁচবে কিনা সেসব চিন্তা নেই।মেয়ে হওয়ার কারণে বড় হলে বিয়ে দিতে পারবে কিনা সেসব নিয়ে আকাশকুসুম চিন্তা করা সেই লোকগুলোর মতো মানুষ তখন আমাদের সমাজে ছিলো এখনও হয়তো আছে।
প্রতিবেিশদের এসব কথাই কষ্ট পেয়েই হয়তো আব্বা আম্মা ছেলে হওয়ার আশা করতো।একের পর এক যখন মেয়ে হতে থাকলো তখন সবার মাথা গরম।এটা নিয়ে সবার মাথা ব্যাথা।আব্বা মসজিদ থেকে শুরু করে মাজার সব জায়গায় গিয়ে কান্না কাটি করেন আল্লাহর কাছে একটা ছেলের জন্য,আম্মাও তাই।আমি পেটে আসার পর বিভিন্ন মানত করতে থাকেন যাতে ছেলে হয়,যদিও বাচ্চা পেটে আসার পরই সে ছেলে হবে না মেয়ে তা নির্ধারণ হয়ে যায়,তা কি আর "মানত" এ পাল্টাবে! কিন্তু ঐ মনের বিশ্বাস বা ছেলে যাতে হয় তার জন্য সব করতে হবে।
সেসব বড় কথা না,বড় কথা হচ্ছে আগের মানুষের ছেলের জন্য ছিলো চরম ঝোঁক।ছেলেই হতে হবে এমন বর্বর ধারণা তাদের মনে বিরাজ করতো।আর সেই ধারণার কারণেই হয়তো আমার আব্বা-আম্মা আমি হওয়ার জন্য এতো আগ্রহী ছিলো।
পরবর্তীতে দেখা গেছে আমার তিন বোনই তাদের সম্মানের কারণ হয়েছে।তারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি বাকরি করে তাদের মর্যাদা বাড়িয়েছে।আব্বা শেষবয়সে যতদিন বেঁচে ছিলেন,ততদিন সব চিকিৎসার খরচ বা ব্যয়ভার আমার বোনরাই বহন করেছে নিজের উপার্জন করা টাকায়।বর্তমানেও আম্মার যত ব্যয়ভার আছে তা আমার বোনরাই বহন করে যাচ্ছে।
এখন দিন পাল্টাচ্ছে,যুগ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনারও পরিবর্তন হয়েছে।উন্নত চিন্তাধারার মানুষ এখন আর মেয়ে হলে মন খারাপ করে না।সন্তানকে শুধু সন্তান হিসাবেই দেখে।
আমার বড় দুই বোনেরই প্রথম সন্তান মেয়ে।আজ আমার বোনদের মধ্যে ছোটো জনের এক ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়েছে।বোন বা বোনজামাই দুইজনই খুব খুশি সন্তান পাওয়ার আনন্দে,সন্তান ছেলে না মেয়ে তাতে কি যায় আসে এই আধুনিক দুনিয়াতে!
অথচ ইসলামে বারবার বলা হয়েছে কন্যা সন্তান কিভাবে আমাদের জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে। দুনিয়াবি চিন্তায় আমরা আমাদের প্রকৃত পুরষ্কার সর্ম্পকে অজ্ঞ হয়ে যায়।
আলহামদুলিল্লাহ,
দোয়া করি সে যেন বাবা-মায়ের সকল আশা পূরণ করতে পারে। আপনার বোনেরা যেমন সমাজের তথাকথিত কুসংস্কার গুলো ভুল প্রমাণ করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে সেও ইনশাআল্লাহ পরিবারে রহমত বয়ে আনবে।
জাযাকাল্লাহ খাইরান
মেয়ে সন্তান মানে ঘরের আলো
সবাই যাতে এটা বুঝতে পারে এই কামনা...
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ খাইরান