নাম নিয়ে গন্ডগোল আর বকুলফুল কুড়ানো

in BDCommunity3 years ago

আমাদের গ্রামের নাম হোসেন্দী।নয়টি ছোট পাড়া নিয়ে আমাদের গ্রাম,আমরা কাজী পাড়ার বাসিন্দা।আমাদের কাজীপাড়া খুব ছোট।রাস্তার পশ্চিম পাশে পঁচিশ ঘর লোক,আর রাস্তার পূর্ব পাশে ত্রিশ ঘর লোক।আমাদের বাড়ি পশ্চিম পাশে।কেনো জানি না রাস্তার পশ্চিমপাশের ঘরের সবাই উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী।আর রাস্তার পূর্বের সবাই কৃষিজীবী,কেটে খাওয়া মানুষ,শিক্ষার সাথে তাদের তেমন করে পরিচয় ঘটেনি।রাস্তার পূর্বের এরা আমাদেরকে বলে পশ্চিমের বাড়ির লোক।কিন্তু আমরা পশ্চিমের এরা ওদেরকে বলি পূবের পাড়ার লোক।এটা নিয়েই ওদের দ্বন্দ্ব কেনো পুবের পাড়া বলি, বলতে হবে বাড়ি।তাদের অভিযোগ আমরা নাকি শিক্ষিত বলে ওদের আলাদা করে রাখি।আসলে বড়দের মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব না থাকলেও আমাদের ছোটোদের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব চরমে।

আমাদের পশ্চিমের পাশের ছেলেমেয়েরা এক গ্রুপ আর পূর্ব পাশের ছেলেমেয়েরা আরেক গ্রুপ।আমাদের দলে গ্রুপ লিডার দুইজন আমি আর রাসেল কাকা।গ্রুপের সদস্যরা মোটামুটি সাত-দশ বছর বয়সের মধ্যে।আমাদের কাজীপাড়ায় একটা বকুল ফুল গাছ।এটা আবার রাস্তার পূর্বপাশে,রাস্তার পূর্ব পাশে একটা দরগা আছে,দরগা বলতে একটা টিলা এর মধ্যে রয়েছে একটা বড় পাথর আর কতগুলো ছোটো ছোট পাথর।কথিত আছে বড় পাথরটি বাচ্চা জন্ম দেয়,এটা জীবিত,এখানে কাঠিতে সুতা পেঁচিয়ে আগর বাতি,মোম জ্বালিয়ে দিলে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হয়।এটার পরিচর্যার জন্য একজন খাদেমও আছেন।এখানে একটা ঈদগাহ মাঠও আছে আবার একটা পুকুর,সবগুলো দরগার সম্পত্তি।

যাইহোক,বকুল গাছটাও দরগার।পূর্বের পাশের দলের দলনেতা মেয়ে,নাম নাহিদা।সে ঘোষণা দিয়েছে বকুল গাছ পূর্ব পাশে হওয়ায় পশ্চিমপাশের ছেলেমেয়েরা ফুল নিতে পারবে না।আমরা আবার বলে পাঠালাম দরগা দুইপাশের এর ফুল আমরা অবশ্যই নিবো।নাহিদা বলে পাঠিয়েছে কাল ভোর সাড়ে পাঁচটায় গ্রামের পুলের উপর সবাইকে যেতে মুখোমুখি কথা হবে।আমরা সবাই সময়মতো উপস্থিত,ওরাও উপস্থিত।নাহিদা বলতে শুরু করলো,"যেহেতু দরগা দুইপাশের সম্পত্তি তাই একটা প্রতিযোগিতা হবে।প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হবে তারাই বকুল ফুল কুড়োবে।রাজি?"
আমরা বললাম,কি প্রতিযোগিতা?
ও আবার বলতে শুরু করলো,আগামীকাল সকালে যে দল ফুল কুড়াতে পারবে,এরপর থেকে বকুল ফুল তাদের।আমরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার,হ্যাঁ রাজি।আমাদের দলের কার্যক্রম চলতো সকাল পাঁচটা-ছয়টা পর্যন্ত,বাকি সময় স্থগিত।কারণ বড়রা এসব জানতে পারলে কারো যে রক্ষা নেই।সেদিন সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে পরিকল্পনা করা হল।আমাদের দলের এক সদস্য শেলিনা,ওরা আজ মামারবাড়ি যাবে।কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করলাম শেলি একা একা বাড়িতে থেকে যাবে।

শেলি একা বাড়িতে আছে,তাই শেলিদের ঘরে ঘুমাবো আমরা কয়েকজন।শেলি বিকালে মোটামুটি সব সদস্যদের মাকে গিয়ে বলে আসলো,আজ আমি বাড়িতে একা ওকে আজকে আমাদের ঘরে ঘুমাতে দিয়েন।সন্ধ্যার পর প্রত্যেকে নিজ দায়িত্বে চুপিচুপি শেলিদের ঘরে চলে আসলাম।হাও কাও করা যাবেনা,তাহলে এই ঘরে এতোজন আছে তা অন্যরা জেনে যাবে।তখন আমরা আট-নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতাম।সাড়ে আটটার দিকে রাসেল কাকা এসে বলে গেলো,তোরা ঘুমিয়ে পর আমি তোদের সময় মতো ডেকে দিবো।আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।

হঠাৎ রাসেল কাকার ডাকে ঘুম ভাঙলো।তাড়াতাড়ি উঠে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম।আমাদের দলের দুজন সদস্যের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ।প্রথমে চলে গেলাম তাদের ডাকতে।ওদের ডেকে আমরা যখন রাস্তার দিকে আসছিলাম তখন আমরা তিনজন লোককে দেখতে পেলাম,তাদের হাতে খুন্তি,শাবল,কোদাল,বস্তা ইত্যাদি।আমরা বুঝতে পারলাম না ওরা কারা।ওরা আমাদের খুব রাগী চোখে দেখছিল।এরপর ওরা রাস্তা দিয়ে চলে গেলো।আমরা রাস্তা পেরিয়ে বকুলগাছের নিচে চলে গেলাম।ফুল কুড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম পূর্বের দিকের দলের জন্য,তারা আর আসেনা।আমাদের দলের সবথেকে ছোট সদস্য আমেনাও এখানে গাছতলায় বসে ঘুমিয়ে গেলো।আমরাও বসে বসে ঝিমুচ্ছি,ঘুম ঘুম অবস্থা।হঠাৎ শুনতে পেলাম মোরগের ডাকের মতো আওয়াজ।সঙ্গে সঙ্গে ওরা সবাই উঠে এসে দেখে আমরা গাছের নিচে বসে আছি।আমাদের দেখে ওরা অবাক হয়ে গেলো।আমরা ওদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে ওদের পরিকল্পনা ছিলো ওদের মধ্যে যে আগে জেগে উঠবে সে বাহিরে এসে মোরগের ডাকের মতো আওয়াজ করলেই ওরা উঠে চলে আসবে।

কথা বলতে বলতে আমরা শুনি ফজরের আজান দিচ্ছে।আমরা তখন ভয় পেয়ে গেলাম।তার মানে মধ্য রাত থেকে আমরা এসে দরগার পাশে বসে আছি,তখনতো আমাদের কাছে ঘড়ি ছিলোনা তাই আমরা বুঝতে পারিনি।বকুল ফুল কুড়ানো সেদিন থেকে আমাদের অধিকার।কিন্তু পরে সবাই নিজেদের মার কাছে বলে দিলো কাল রাত কি হয়েছে।আর ঐ যে তিনজন লোক দেখেছি,তখন বড়রা বলতে লাগলো ওরা নিশ্চয়ই চোর ছিলো,ভাগ্য ভালো যে তোদের ওরা কিছু করেনি।আর মাঝরাতে তখনকার দিন চোর থাকা স্বাভাবিক ছিলো।এরপর থেকে সবার মায়েরা সতর্ক হয়ে গেলো,সকাল সকাল ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ।তাই বকুল ফুল আর কুড়ানো হতো না।এরপর দুইদল মিলেমিশে বিকালে খেলা করতাম।তখন ওদের আমরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী বলতাম "পুবের বাড়ি"র দল।কিন্তু যখন একটু মতের বিরোধ হতো তখনি আমি আর রাসেল কাকা বলতাম,এই তোরা চলে আয় পুবের পাড়ার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই।তখন আবার বিরোধের সৃষ্টি হতো।কয়েকদিন পর আবার মিলমিশ।এভাবেই চলতো আমাদের দিন।

কবে যে দিনে দিনে বড় হয়ে এসব ছেড়ে চলে এসেছি বুঝতেও পারিনি।দুঃখের সাথে বলতে হয় পুবের পাড়ার লিডার নাহিদা আপু বিয়ের পর সন্তান জন্মদিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।সৃষ্টিকর্তা ওনার আত্মাকে শান্তিতে রাখবেন এই কামনা।

এইযে পাড়ার নামকরণ এটা নিয়ে আরেকটা কাহিনি আজ মনে পড়ছে।আমাদের হোসেন্দী গ্রামের নয়টা পাড়ার মধ্যে একটা পাড়ার নাম "জালোপাড়া"।আমাদের এলাকায় জেলেদেরকে জালো বলা হয়।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পাড়ার বেশিরভাগ মানুুষ শিক্ষিত,চাকরিজীবী,ভদ্রলোক, দু-এক জন জেলে আছে।হয়তো একসময় এই পাড়ায় জেলে ছিলো বেশি, কারণ পাশেই একটি গাং ছিলো,তাই তখন পাড়ার নাম হয়েছিলো জালোপাড়া।সে যাইহোক,ঐ এলাকার মানুষের এই জালোপাড়া নামটি পছন্দ নয়।তাই ওরা ওদের গ্রামের নাম রেখেছে মোকামপাড়া।খাতাপত্রে মোকামপাড়া থাকলেও মানুষের মুখে মুখে জালোপাড়া নামেই পরিচিত,মোকাম পাড়া বললে কেউ চিনতেই পারতো না।তাই এলাকার গণ্যমান্য সবাই বসে ঠিক করলো পাড়ার সবাই মিলে একটা ভূড়িভোজের আয়োজন করা হবে।ঐখানে নয়পাড়ার সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হবে।নিমন্ত্রণের শর্ত থাকবে ওদের পাড়াকে মোকামপাড়া বলে ডাকতে হবে,জালোপাড়া বলা যাবে না।

কথা অনুসারে কাজ।একটা তারিখ ঠিক করা হলো।মাইকিং করে সারা গ্রামে নিমন্ত্রণের সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হলো এবং সাথে শর্ত সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো।ভূরিভোজের দিন সবাই দলে দলে নিমন্ত্রণ খেতে যাচ্ছে, পথেরমধ্যে ওদের যখন জিজ্ঞেস করা হল,তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
ওরা উত্তর দিলো," মোকামপাড়া" যাচ্ছি নিমন্ত্রণ খেতে।কিন্তু নিমন্ত্রণ খেয়ে বাড়ি ফেরার সময় যখন তাদের জিজ্ঞেস করা হলো,তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?তখন ওরা উত্তর দিলো,"জালোপাড়া" থেকে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসলাম।যেই লাউ সেই কদু।এতোকিছু করার পরও সেই পাড়া আজও জালোপাড়া নামেই পরিচিত।তারজন্যই হয়তো গ্রামের লোকে বলে,"গাং ভরাট হয়ে যায়,কিন্তু তার রেখা অবশ্যই থেকে যায়।"

সমাপ্ত

IMG_20200625_184712.jpg