দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন এক আঙ্কেল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?” জবাবে আমি বলেছিলাম, “সুখী, আমি সুখী হতে চাই।” কী ভেবে বলেছিলাম আজ আর মনে নাই। আরেকবার মাসুদ রানার একটা বইয়ে পড়েছিলাম, “আনন্দময় মুহুর্তগুলোই জীবনের সম্পদ, বাকিসব অর্থহীন জঞ্জাল।” পরবর্তীতে বড় হয়ে যখন ডায়োজেনিস আর মহাবীর আলেক্সান্ডার এর আলাপন পড়লাম নাইজেল ওর্বাটনের বইয়ে তখনও আমি আমার লক্ষ্যে অটল ছিলাম। একদিন মহাবীর আলেক্সান্ডার ডায়োজেনিস এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি ডায়োজেনিস এর জন্য কী করতে পারেন। ডায়োজেনিস তখন সকালবেলা রোদ পোহাচ্ছিলেন তাই আলেক্সান্ডারকে কেবল সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন কারন আলেক্সান্ডার এর কারনে ডায়োজেনিস এর শরীরে রোদ লাগছিলো না। এতোটুকুই ছিল তার চাওয়া। তো, মোদ্দাকথা হলোঃ আমি আজীবন চেয়েছি সুখী হতে। সামান্য কিছুদিন কষ্টে থাকলেও আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি সুখেই কাটাতে পেরেছি এই দর্শন অনুসরণ করার কারনে।
তো, হঠাত একদিন আমি MUBI তে এই সিনেমা আবিষ্কার করি। Perfect Days (2023) আমাকে শিখিয়েছে যে একজন মানুষ কত অল্পতেই সুখী জীবন যাপন করতে পারে! ১২৩ মিনিট এর এই সিনেমাটা আমার জন্য ছিল ধ্যানের মতো যেন এই সময়টুকু আমি নিজের অন্তরের গভীরে ডুব দিয়ে ঘাপটি মেরে নিজেকেই দেখছিলাম। আমি যা যা পছন্দ করি বেছে বেছে পরিচালক যেন আমাকে তা-ই দেখাচ্ছেন। সত্যি বলতে আমার Wim Wenders এর সিনেমা দেখায় হাতেখড়ি হয়েছেই এই সিনেমা দেখে। এই সিনেমা আমাকে এতোটাই আচ্ছন্ন করে রাখছিল যে আমি মেকিং, সিনেমাটোগ্রাফি, মিউজিক অত খুঁটিয়ে দেখার/শোনার সুযোগই পাই নি। আবার দেখলে হয়ত ওসব খুঁটিয়ে দেখবো এবং শুনবো।
কাহিনী সম্পর্কে আমি অল্প কিছু কথা বলবোঃ টোকিও শহরে মধ্যবয়সী এক লোক হিরায়ামা টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ করে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দ্রুত বিছানা গুছিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে সে তার ভ্যান নিয়ে। ভ্যানের ভেতরেই তার সব যোগাড়-যন্ত্র। যেতে যেতে পথে শোনে নিজের পছন্দের গানগুলো। গান শোনার পদ্ধতিও তার সেকেলে। এখনও সে ক্যাসেট-এর গান শোনে। মোটামুটি অতীতে বসবাস করে ভদ্রলোক। টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ করে অত্যন্ত যত্নের সাথে। যেন এটা তার কোন রিচুয়াল। কাজ শেষ হয়ে যায় ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে। কাজ বলতে এইটুকুই। এরপর সে পার্কে বসে প্রকৃতি দেখে। মান্ধাতা আমলের এক সাদাকালো ক্যামেরা দিয়ে গাছের ক্যানোপি’র ছবি তোলে। এরপর বাড়ি ফিরে আসে, সাইকেল চালিয়ে গিয়ে বাজার করে, পাবলিক গোসলখানায় গোসল করে। এরপর সে তার নিজের মতো দিন যাপন করেন। মোটামুটি সবকিছু রুটিনে বাঁধা। মজাটা এখানেই। আমরা হলে হয়ত আরও বেশি রোজগারের জন্যে আরও বেশি কাজ করতাম। আড্ডাবাজি করতাম। হই হুল্লোড় করতাম। কিন্তু হিরায়ামা এতসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে নদীর মতো নিস্তরঙ্গ বয়ে চলে। দুনিয়া যেখানে যাবে যাক, সে তার মতো দিন কাটাবে। রাতে উইলিয়াম ফকনার পড়ে ঘুমাবে। টাকাপয়সা অল্প হলেও সে টাকাকে হাতের ময়লা ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। দেখতে দেখতে বার বার আমার মনে হয়েছিলঃ আরে! আমি তো এমন জীবনই চেয়েছিলাম। যে জীবনের প্রতিটা মুহুর্তেই আমি বাঁচবো। বর্তমান নিয়ে বাঁচবো। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে ভারাক্রান্ত করবো না। অতীত নিয়ে দুশ্চিন্তা করবো না। এটাই তো জীবন। Alive every second! এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা আসলে। লিখে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। দেখবেন প্লিজ।
তার ভাগ্নির সাথে পার্কে বসে হিরায়ামা গাছ দেখছে।
প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সে এভাবে প্রকৃতির দিকে তাকায়। আমারও এই অভ্যেস আছে।
আহা কি শান্তি...
এর বেশি আর কী-ই বা চাই জীবনে!
হেমন্তের সকালের সোনারোদে কার না মন চায় সাইকেলে ঘুরে আসতে!
হিরায়ামার ক্যাসেট কালেকশান। অনেক দাম বর্তমান বাজারে।
অল্পতেই আসলে জীবন সুন্দর।
All the pictures are sourced from IMDb