রাত দশটা। লোডশেডিংয়ের কারণে রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। জড়োসড়ো হয়ে কয়েকটা মেয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্টস ওয়ার্কার তারা। মাত্র অফিস ছুটি হয়েছে। যদিও বিধি মোতাবেক দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশি ডিউটি করার কথা নয়। কিন্তু তাদেরকে প্রতিদিনই বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করা লাগে। না করার কোন উপায় নেই। করতে না চাইলে আউট।
কোন কোনদিন এগারোটা-বারোটাও বেজে যায়। বিশেষ করে যখন শিপমেন্টের তারিখ নিকটে আসে। বাড়িওয়ালারা ঘ্যান ঘ্যান করে: এত রাত পর্যন্ত মাইয়া বাইরে কি করে কে জানে! গার্মেন্টস ওয়ার্কার শুনলেই সবাই মনে করে খারাপ কিছু।
গলির মোড়ে কয়েকটা বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি অন্য সবার সাথে যাচ্ছে। মেয়েদের এক একজন অশ্লীল খিস্তি দিচ্ছে, আর একজন আরেকজনের গায়ে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে। শিউলির কেমন ঘিনঘিন লাগে। সে এখনও এ ধরনের খিস্তিতে অভ্যস্ত হয়নি। সেই গ্রাম থেকে এসেছে মাত্র এক সপ্তাহ হল।
হঠাৎ মোড়ের ছেলেগুলোর ভিড় থেকে ষন্ডামার্কা একটা ছেলে আংগুল তুলে ডাক দিলো: এই মেয়ে, এদিকে আসো..
নাসরিন শিউলির ডানা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল: তোরে পল্টু ভাই ডাকে। তোর তো কপাল খুইলা গেছে লাগে।
পাশ থেকে শ্যামা বলে উঠলো: শুধু কপাল খুললেই হয়। অন্য কিছু যদি খুলে যায়.. বলে তারা হাসতে হাসতে একজন একজনের গায়ে ঢলে পরলো।
নাসরিন মুখ বেঁকিয়ে বলল, মাইয়া এখনো না খুলে বাকি রাখছে নাকি? গাঁও-গেরাম কি হয় সব জানা আছে।
শিউলির বুক ধুকপুক করতে শুরু করলো। এগুলো কি বলছে? সে আমতা আমতা করতে লাগল..
নাসরিন বলল: ভাই ডাকছে। তারাতারি যা। নাইলে কপালে খারাপি আছে।
শিউলি কাঁপতে কাঁপতে পল্টু ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল।
পল্টু ভাইয়ের মুখে সিগারেট। ইয়া মোটা গোফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শরীর থেকে ভুর ভুর করে নিকোটিনের গন্ধ আসছে। তিন চার হাত দূরে থেকেও সেই গন্ধ পাওয়া যায়।
-এই এলাকায় নতুন আসছ? কি নাম?
-শি..শি..শিউলি
-হুম। দেখতে তো ভালোই। কোন বস্তিতে উঠছ?
দূরে থেকে নাসরিন বলল: পল্টু ভাই, আমার পাশের খুপড়িতে থাকে।
পল্টু ভাই নামক লোকটা দাঁত বের করে একটা খিস্তি দিয়ে বলল: তরে জিগাইছি নে মাগি?
তারপর শিউলির দিকে ফিরে বলল: ঠিক আছে মেয়ে। যাও আজকে। কেউ কোন ডিস্টার্ব করলে আমারে কইবা। আমি থাকতে তোমার কোন টেনশন নাই।
শিউলি আসা মাত্রই মেয়েদের জটলাটা হো হো করে হেসে উঠল: কইছিলাম না। তোর ভাগ্য খুইলা গেছে। পল্টু ভাইয়ের নজরে পড়ছো। আর কোন টেনশন নাই। যা লাগে ভাইরে কইবা। হা হা হা।
ভয়ে শিউলির চোখে পানি চলে এসেছে। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল।
রাতে শিউলির দরজায় ঠক ঠক শব্দ। সে ভয়ে দরজা খোলে না। সারারাত কান্না করে। শেষ রাতের দিকে গিয়ে সামান্য একটু করে ঘুম আসে। সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে নাস্তা না করেই গার্মেন্টসের দিকে দৌড় দেয়।
সুপারভাইজারের ততক্ষণে হাজিরা নেয়া শেষ। শিউলি এসে দাঁড়াতেই সুপারভাইজার উপরের পান খাওয়া দাঁত বের করে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে: কি ব্যাপার! লেইট করলি যে? আজকে তোর অ্যাবসেন্ট।
শিউলি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল: স্যার। আজকের মত মাফ করে দেন। একদিন দেরী হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠতে পারি নাই।
সুপারভাইজার শিউলি কাঁধে হাত রেখে বলল: তোদেরকে কইছি না- নিয়ম নিয়মই। শুধুমাত্র তোর জন্য আজকের মত অ্যাবসেন্ট লিখলাম না।
শিউলির কাঁধ শিরশির করে উঠল। সে সুপারভাইজারের ইঙ্গিতপূর্ণ চাপ ঠিকই বুঝতে পারলো। এই লোকটার হাতে তাদের সবার অ্যাটেনডেন্স এবং ওভারটাইমের হিসাব থাকে। সেজন্য বদ চরিত্রের লোকটা যখন তখন যে কোন গার্মেন্টস ওয়ার্কারের গায়ে হাত দেয়। কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।
হঠাৎ শিউলির মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল: পাইছেন কী? কী পাইছেন আপনারা? গার্মেন্টস ওয়ার্কার বইলা মানুষ না আমরা! যখন তখন গায়ে হাত দিবেন! মাইয়া নাই আপনার? বোন নাই? আমাদের দেহ কি এত সস্তা হয়্যা গেছে?
সুপারভাইজার আমতা আমতা করতে শুরু করলো: আরে কি হলো? আমি তো তোমারে বুঝানোর চেষ্টা করতেছিলাম নিয়ম কানুন।
-হ, নিয়ম কানুন শুধু আমাগো লাইগা আছে। আপনগো লাইগা কোন আইন কানুন নাই। আমরা এখানে রক্তঘাম বেইচা দুইটা টাকা রোজগার করতে আসছি। ইজ্জত বিক্রি করতে আসি নাই।
তাদের চারদিকে ভিড় জমে গেছে। নাসরিন এসে বলল: কি হয়েছে রে শিউলি? এরকম চিল্লাইতেছ কেন?
-এই লোকটা পাইছে কি- কথায় কথায় গায়ে হাত দেয়?
-কেন কি হইছে?
শিউলি বলতে শুরু করল কিভাবে লোকটা বুঝানোর ভান করে শিউলির কাঁধে হাত রেখেছিল।
নাসরিন নাক সিঁটকে বলল, এই ঘটনা? এটার জন্য এত চিল্লাচিল্লি করা লাগে?
শিউলি যেন আকাশ থেকে পড়লো! একটা মেয়ে হয়ে নাসরিনের কাছে এটা কোন তুচ্ছ ঘটনা! তার মুখে ঘৃণার থুথু জমে গেল। সে একটা থুতুর দলা মাটিতে ফেলে বলল: হ। তোমাগো কাছে তো এটা কিছুই না। ইজ্জত বলে ত তোমাদের আর কিচ্ছু নাই। থাকো তোমরা। করলাম না তোমাগো চাকরী।
শিউলি বেরিয়ে চলে আসলো। সে জানে, এই ফ্যাক্টরিতে সুপারভাইজারের সাথে এরকম আচরণের পর তার চাকরি আর থাকবে না।
সে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই নষ্ট শহরে আর থাকবে না। গ্রামে গিয়ে প্রয়োজনে গরু ছাগল পালবে, হাঁস মুরগি পালবে, অথবা মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাবে।
গার্মেন্টসের গেট থেকে বের হতেই দেখে সিগারেট টানছে পল্টু। তাকে দেখে ডাক দিল।
আজকে শিউলির আর ভয় করছে না। সে সিনা না টানটান করে এগিয়ে গেল।
-শিউলি, আজকে এত তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলা যে? শরীর খারাপ নাকি? ইয়ে হচ্ছে?
-ইয়ে মানে কি? ঠান্ডা শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল শিউলি।
-ইয়ে মানে বুঝ না? মাইয়া মাইনষের যেটা হয় আর কি। হা হা হাহা।
_-এইটা নিয়া হাসাহাসির কি আছে? তোমার মায়েরও তো এইটা হয়, নাকি?
পল্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কালকে যে মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছিল তার সামনে, আজকে তার হঠাৎ কি হল?
শিউলি তখনও বলে চলেছে: পিরিয়ড নিয়া ঠাট্টা কইরা খুব মজা পাও? এইটা না হৈলে তোমার জন্ম হৈতো না। নিজের জন্ম নিয়া ঠাট্টা করতে শরম করে না?
শিউলির কথাগুলো পল্টুর ভেতরটাকে হঠাৎ করে কাঁপিয়ে দিল। এরকম এরকম কাপ নেতার কখনো ওঠেনি। এরকম কথাও কেউ তাকে কখনো বলেনি।
সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি তাকে পেছনে ফেলে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে খুব দ্রুত গাবতলী যেতে হবে। সন্ধ্যার আগেই গ্রামে পৌঁছতে হবে।
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
দাড়ুণ হয়েছে। আমাদের সমাজে এইসব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
বিশেষ করে টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোতে মেয়েদেরকে এ রকম নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা বিচার পায় না অথবা বিচার দেয় না। কারণ বিচার দিতে গেলে চাকরি চলে যাবে, ওভারটাইম কেটে দিবে, অ্যাবসেন্ট দেখাবে এবং সমাজের কেউ তার পাশে থাকবে না। তাই তারা মুখ বুজে সহ্য করে।
হুম। আমাদের সমাজে এরকম অহরহ চলছে। মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ও গড়ে তুলেছে।
Twitter account tariqul82741762 was registered to Hive account tariqul.bibm!
Hi @tariqul.bibm, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @rehan12!
Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.
JOIN US ON
শিউলির মতো এমন সাহসী মেয়ের দরকার এদেশে। যাই হোক, সবমিলে গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিলো ভাই।