মন খারাপের সাথে সন্ধি

in BDCommunity3 years ago

মন খারাপের সাথে সন্ধি

বা পাশে পরে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই সময়টার দিকে চোখ পড়লো। বেলা অনেক হয়ে গেছে। সেই ভোরে করমচার মত রং নিয়ে ওঠা সূর্যটা এতক্ষণে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে অনেকটাই। আজ রোদের তেমন তেজ নেই বললেই চলে। খুব ইচ্ছে ছিল আজ দুপুরে নিজের হাতে ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস ভূনা করবো, আয়েশ করে পায়ের উপর পা তুলে খাবো। তা আর এই মন খারাপের অসময় আগমনে হয়ে উঠলো না। অলস বিড়ালের মতো হাত পা গুটিয়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। আজ আমার মনের বারান্দায় মন খারাপের দল এসেছে। সাথে এসেছে ওদের হাজারো অভিযোগ।

হুটহাট এই মন খারাপের ভিড় করাটা আমি খুব মানিয়ে নিয়েছি নিজের সাথে। মানিয়ে নিয়েছি নিজের সমস্ত অনুভূতির সাথে। এই যে মন খারাপের রঙিন সারি, কোন সেই বিশেষ কারণে এই মন খারাপ জানি না আমি। আমার প্রায় সময়ই মনে হয় আমার এই কারণ ছাড়া অনুভূতিহীন মন খারাপের একটা জন্মদিন থাকা দরকার। ঠিক তারিখ গুনে তো আর তারা হাজির হয় না তাই তাদের জন্মদিন হিসাব করাটাও ভারী কঠিন আমার কাছে। যদিও এই মন খারাপের কারণ নামহীন তবুও এই মন খারাপের হাজারটা বায়না, তাদের সমস্ত বায়না আমার কাছে। আমি গালে হাত দিয়ে খুব মনোযোগী ছাত্রীর মত শুনে যাই তাদের অগোছালো সব বায়না। সেইসব বায়নাতে আমি খুঁজি আমার পুরনো আমি কে, আমি খুঁজি আমার হারিয়ে যাওয়া রঙিন ফানুসের মত সুন্দর দিনগুলোকে।

window-view-1081788_960_720.jpg

বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়। আমার ক্ষুদা তৃষ্ণা সব শিকেয় তুলে মন খারাপেরা আজ তাদের সব অভিযোগের বিশাল ফর্দ আমার চোখের সামনে তুলে ধরে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি,গুনতে থাকি সেই অভিযোগগুলো একটা একটা করে। সেইসব গুনতে গুনতে উঠে বসি এলোমেলো অগোছালো বিছানাটায়। সামনে থাকা বড়ো আয়নাটায় হঠাৎ চোখ পড়ে। নিজেকে একটা নতুন মানুষ হিসেবে দেখতে পাই আমি। মনে হয় যেন আয়নায় থাকা ওই নতুন মানুষটা আমায় দেখে হাসছে। আমি তার কাছে নিতান্তই একটা অপদার্থ ছাড়া আর কিছুই নই। সকাল বেলার মিষ্টি রোদের মতন ওই নতুন মানুষটার চোখের মায়া যেনো ঠিকরে পড়ছে ,সূর্যালোকের চাহনির মত ভয়ংকর তির্যক মনে হয় তার চোখের চাহনি। তার হাসির রহস্যটা আমার কাছে ঠিক ওই মাধ্যমিক ভূগোলের প্রথম গাণিতিক অধ্যায়ের মত জটিল মনে হয়।

হঠাৎ জেগে উঠি, খেয়াল করে দেখতে পাই আমি নিজেকেই নিজে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছি। আমি নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, সবচেয়ে বেশি। মানুষ নিজেকে ভালো না বাসলে তো আর কাউকে সে ভালোবাসতে পারে না, সেই ক্ষমতা তার থাকে না তখন। তাই নিজেকে ভালোবাসতে হয় সবার আগে। সবাই সেটা পারে না। আমি পারি,আমি পেরেছি হাজার বার। আমি আমার আমিকে ভালোবেসেছি বলেই আজ এই মন খারাপেও আমি দিব্যি হাসতে পারছি, গাইতে পারছি, আয়নায় দেখা অলস আর মুখ গোমড়া আমি টাকে আমি প্রশংসা করতে পারছি নির্দ্বিধায়। এইভাবে যখন নিজের ভেতরটা আমি বিশ্লেষণ করি মনে হয় মানুষের চেয়ে জটিল কিছু বোধহয় দুনিয়াতে আর নেই।

মানুষ তো আমি, রক্ত মাংসে গড়া একটা জীব। কষ্ট হয়,মন খারাপ হয়, কাদতে হয় আবার হাসতেও হয়। তবে ভেঙ্গে পড়ি না....নিজেকে ভালোবেসে আবার বাঁচিয়ে তুলি, আবার শক্তি জোগাই। দিনশেষে তো আমার আমি ই থাকি নিজেকে সান্তনা দেয়ার, নিজেকে নতুন আরেকটা দিনের জন্য তৈরি করার।
ঐযে,আমার মন খারাপেরা,আজ বায়না ধরেছে। তাদের নিয়ে আজ হাওয়াই মিঠাই খেতে যেতে হবে, আজ তাদের আকাশে ওড়ার মত বিশাল স্বাধীনতা দিতে হবে, আজ তাদের সমস্ত অভিযোগ আমার মাথা পেতে নিতে হবে। না হয় তারা যাবে না কিছুতেই। আমার দিনের শুরু হতে দিবে না, আমাকে আবারো কর্মব্যস্ততায় ডুবে যেতে দিবে না। ওদের বায়নাই শুনলাম। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ,নিজেকে তৈরি করে নিলাম। আজ মন খারাপের সাথে সন্ধি গড়বো, ওদের জন্য ঘটা করে জন্মদিন পালন করবো।

আমার অনুভূতির খাচায় থাকা মধ্যরাত, ভোর সকাল,দুপুর আর অবেলার আকাশকে আজ আর বের করলাম না খাচা থেকে। মন খারাপদের সঙ্গে নিয়ে পারি জমালাম সমুদ্র দেখতে। পথের ধারের হাওয়াই মিঠাই, প্রাণখোলা বাতাস সবকিছু মিলিয়ে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার মন খারাপের দলের সাথে। আমি আবারও হাসিমুখে বাড়ি ফেরার কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম, আমি আবারও তৃপ্তি ভরে ঘুমানোর সুযোগ খুঁজে পেয়েছিলাম। কারণ আমি আমার মন খারাপকে নিজের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিলাম। আমি ওদের সুযোগ দেইনি আমাকে কাদানোর, সুযোগ দেইনি আমার থেকে আমার আমিকে দূরে সরিয়ে দেয়ার। আমি আরো একবার পেরেছিলাম নিজের অনুভূতির সাথে লড়তে।

মন খারাপের জন্মদিন পালন শেষে গোধূলির রাঙা আলোয় আমি হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম। আরো একবার নিজেকে আয়নায় দেখলাম। সেই গোমড়া মুখো মানুষটা এখন কতটা সুন্দর, কতটা শান্ত, কতটা স্নিগ্ধ তার হাসিটা। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদটার মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আয়নার মানুষটাকে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না তার কাছেও মন খারাপেরা ভিড় জমায়, তার হাতেও তুলে দিতে পারে বিশাল এক মন খারাপের ফর্দ। সমস্ত মন খারাপেরা হাওয়াই মিঠাই হয়ে ভেসে গেছে সন্ধার ম্লান আকাশে, ঠাই পেয়েছে আনন্দের ফানুশ।
সেই দুপুরের মধ্যভাগে দেখা অলস মানুষটাকে কি চটপটে, কি সতেজ লাগছে এখন!

সারাদিনের শেষে এখন ক্ষুদাটা চেপেছে খুব। চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে দিয়ে ভাবছিলাম আজকের বিকেলটা সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল। আর সন্ধ্যার চাহনিটা ছিল রহস্যময় সুন্দর। এইসব ভাবতে ভাবতে ভেতরে কেমন একটা লোভ কাজ করছে, কাজ করছে প্রবল একটা ইচ্ছা । ইচ্ছে হচ্ছে মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকি আর তারা ভরা আকাশটা দেখি। এরকম লোভ সামলাতে পারা আমার মত দুর্বল মানুষের পক্ষে সম্ভব না কোনোদিনই।

রাতের খাবারটা সেরে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আবার মনে হলো আগামীকালের নতুন সকালটাও আমার সেই বিকেলের প্রতীক্ষায় কেটে যাবে আমি জানি। যখন সব মন খারাপেরা বিদায় নেয়, হাজির হয় আনন্দগুলো তখন আবারও নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হয়, আনন্দগুলোকে আরো কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে তুলতে ইচ্ছে হয়।

চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। হুট করে মুচকি হেসে উঠলাম এই ভেবে যে আমার মধ্যে বেচেঁ থাকা ছেলেমানুষীটাকে, মন খারাপ বিদেয় করার ইচ্ছেটাকে কোনোদিন আমি মরে যেতে দিবো না। যতদিন বাঁচবো এইভাবে নিজেকে ভালোবাসবো, নিজের মন খারাপগুলোকে কোনোদিনই সুযোগ দিবো না জিতে যাওয়ার।

মধ্যরাতে তারা দেখার ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ ঐযে আমি মানুষ, কর্মব্যস্ততা, তাড়াহুড়ো এইসব ই তো আমার জীবন। মাঝে মাঝে নিজের জন্য, নিজের মন খারাপের জন্মদিনের জন্য একটু ছুটি নেয়াই যায় কিন্তু সেই অজুহাত তো সবসময় খাটে না। তাই ঘুমিয়ে পড়লাম নতুন একটা ভোর দেখার আগ্রহ নিয়ে। আর স্বপ্নে গুনতে লাগলাম মধ্যরাতের সেই ঝলমলে তারা!

Image score