প্রিয় মানুষ , প্রিয় স্মৃতি

in BDCommunity3 years ago (edited)

প্রিয় মানুষ , প্রিয় স্মৃতি

হুট করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। দুই হাতে চোখ কচলে তাকাতেই মনে হলো মাঝরাত হবে হয়তো। এই তিনটা সাড়ে তিনটা এমন বাজছে হয়তো ঘড়িতে। হুটহাট কোনো কারণ ছাড়াই এই সময়টায় ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাথায় হাজারটা রঙিন স্মৃতি এসে নাড়া দেয়। তাই মাঝরাতের এই সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়। এইযে, আমার পাশে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমার প্রিয় মানুষ টা, ওকে নিয়েই তো আমার স্মৃতির শেষ নেই। আমার শেষ সময় পর্যন্তও যদি বলে যাই ওকে নিয়ে শেষ হবে না হয়তো।

একদম প্রথম ওকে দেখেছিলাম আমাদের বাসায়। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল আমার মায়ের কাছে। আমার বাবা আমাকে সেই ছোটবেলাতেই ছেড়ে গেছেন, ওই আকাশের বুকে তারা হয়ে আছেন এখন তিনি। এখনো কানে আসে কথাগুলো -

  • এই, এই পাত্রপক্ষ তো এসে গেছে। আয়েশার শাড়ি পড়া হলো??
  • হ্যাঁ, এইতো শেষ। ও একদম তৈরি। কি সুন্দর! পরীর মত লাগছে আমার মেয়েটাকে!
    আমি সেদিন কী ভেবে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম ঠিক জানি না। পাশে থাকা আমার বোন বলে উঠলো - আজকে আপুকে দেখে ছেলের চোখ সরানো বারণ!
    আমি ওকে ধমক দিয়ে চুপ করালাম।
    সেদিন একটা গাঢ় গোলাপী শাড়ি পড়েছিলাম, দুই হাতে দু মুঠো কাচের চুড়ি ছিল, লম্বা চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা বেধে দিয়েছিল মা। চোখে একটুখানি কাজল। ব্যাস, ওইটুকুই ছিল আমার সাজ। পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে তাদের সালাম দিয়ে বসে পড়লাম সোফায়। আমাকে টুকটাক কিছু কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি শান্ত গলায় উত্তর দিয়ে গেলাম। আড়চোখে সেদিন দেখেছিলাম আমাকে দেখতে আসা ছেলেটা আমার দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে এমন চমকপ্রদ কিছু দেখেছে যেখান থেকে চোখ ফেরানো বারণ! বড়ো লজ্জায় পরে গিয়েছিলাম আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে।

সেদিন ওই ছেলেটার সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। তাদের নাকি ভারী পছন্দ হয়েছিল আমাকে। তাই পাকা কথা দিয়ে তারা চলে গেলেন। আমার মা ভীষণ খুশি। পরে তারা ফোনে জানিয়েছিলেন ঠিক চারমাস বাদে তারা বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন। মায়ের কোনো আপত্তি ছিল না তাতে। এরমধ্যে আমার অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষাটাও শেষ হয়ে যাবে আর পাত্রপক্ষেরও সবকিছু গুছিয়ে নিতে সুবিধা হবে।

তো, ওই কথা মতই চলতে থাকলো সবকিছু। কাটতে লাগলো দিন। একদিন ভার্সিটি শেষে বাড়িতে এসে হাতমুখ ধুয়ে বসেছি মাত্র এমন সময় কল এলো একটা। নাম্বারটা অপরিচিত। তাও কেনো যেনো রিসিভ করলাম। ফোনের ওই পাশের মানুষটা "হ্যালো , আয়েশা বলছেন?"কথা টা বলতেই মনে হলো হারিয়ে গেলাম। একটা মানুষের কন্ঠ এত সুন্দর হতে পারে! নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে বললাম"জি",আপনি?"
সে বলল,"বাহ্,নিজের হবু স্বামীকে চিনতে পারছেন না?""একমাস ও হয়নি আপনাদের বাসায় গিয়ে দেখে এলাম আপনাকে, এর মধ্যে ভুলে গেলেন!" আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে সে একদমে সবগুলো কথা বলেই হেসে ফেললো।

  • না,না,এমন কিছু না। নাম্বার টা চিনি না তো তাই আর কি।
    কোনরকম নিজেকে বাচালাম আমি।

এরপর থেকে মাঝে মধ্যে আমাদের কথা হতো, দেখা হতো। একদিন আমাকে সেই গোলাপী শাড়িটা পড়ে দেখা করতে বললো সে। সেদিন হাতে কাজ ছিল না, ভার্সিটি বন্ধ ছিল। বিকেলের দিকে শাড়িটা পড়ে নিয়ে, চুলগুলো খোঁপা করে আরো একবার নিজেকে আয়নায় দেখে বেরিয়ে গেলাম। আগে থেকে ঠিক করা জায়গাটায় গিয়ে দাড়াতেই অবাক হয়ে গেলাম একদম। খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো পুরোটা জায়গা। আমি তাকিয়েই ছিলাম একদৃষ্টিতে। হুট করে পেছন থেকে আয়েশা বলে ডেকে উঠলো সেই মিষ্টি মায়া মেশানো কন্ঠটা। ঘুরে দাড়াতেই দেখলাম সে হাতদুটো পেছনে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। গায়ে একটা কালো পাঞ্জাবি,চুলগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। বিকেলের ওই হালকা রোদে এত সুন্দর লাগছিল ওকে! আমি কোথায় যেনো হারিয়ে গেলাম আবারও! ও কাছে এসে আবার নাম ধরে ডাকতেই খেয়াল হলো ও এখনো হাতদুটো পেছনে নিয়ে দাড়িয়ে। কেমন আছি,শরীর ভালো কিনা এইসব জিজ্ঞেস শেষে হুট করে বলে উঠলো তোমার একটা হাত দাও তো! আমি বাচ্চাদের মত দুটো হাতই বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার ডান হাতটা নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে খুব সুন্দর একটা বেলী ফুলের মালা পরিয়ে দিল। এত যত্ন করে কোনো ছেলে কারও হাতে ফুলের মালা পরিয়ে দেয় আমি জানতাম না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম চুপচাপ আর দেখে গেলাম ওর মালা পরিয়ে দেয়াটা। ঠিক সেদিন থেকেই ও আমার প্রিয় মানুষ।

আমার জন্য এত এত উপহার অপেক্ষা করছিল যার বিন্দুমাত্র ধারণা আমার ছিল না। এরপর থেকে যখনই আমাদের দেখা হতো ও আমার জন্য রঙিন খামে মোরা চিঠি নিয়ে আসতো। হাতের লিখা ওর তেমন সুন্দর ছিল না তবে ওর কথার গাঁথুনি আমাকে মুগ্ধ করতো বারবার। সেই মুগ্ধতা এখন অবধি সেই আগের মতই। প্রায় সাতটা বছর কেটে গেছে ওর সাথে এই মুগ্ধতার উপর ভর করেই।

শুধু কী চিঠি, ফুল এইসব? একদিন তো প্রায় দশ বারো জোড়া কবুতর নিয়ে আমার বাসার সামনে হাজির। আমার মা সেদিন এত হেসেছিল।বলেছিল "ও তোকে ওর সবটা দিয়ে আগলে রাখবে, দেখিস" ! সত্যিই ও আগলে রেখেছে আমাকে, এত এত যত্ন আর মায়া দিয়ে আগলে রেখেছে। তারপর থেকে আমাদের বাসার ছাদ ভর্তি কবুতর উড়ে বেড়াত। আর এই কারণে আমার প্রতিটা বিকেল আমি খুব উপভোগ করতাম ছাদে।

ওর সাথে বিয়ে হওয়ার ঠিক একমাস আগে আমার জন্মদিন ছিল। ও সেই খবর আমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নেয়। আমার কোনো ধারনাই ছিল না। সেদিন সকাল থেকে ওর সাথে আর কথা হয়নি তেমন। ভার্সিটি, পরীক্ষা সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম আমার জন্মদিনটাতে। মনেই ছিল না কিছু। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে যখন বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরলাম, মা আমাকে সবকিছু এগিয়ে দিল, হাতমুখ ধোয়া শেষে গামছা টা হাতে এনে দিল। যত্ন করে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম আজ হলো টা কি! আজ কি বিশেষ কিছু আছে নাকি? হঠাৎ এতো যত্ন হচ্ছে? ক্লান্ত থাকায় মা কে আর কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না। নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বাতিটা নিভিয়ে। আর ঐদিকে পুরো ছাদ ফুল দিয়ে সাজানো, নিজের হাতে কেক বানানো,আমার জন্য উপহার কেনা, পুরো একবক্স ভর্তি রঙিন খামে চিঠি, আমার প্রিয় সব খাবার মানে একটা কিছু বাদ পড়ে নি। নিজের হাতে সবটা করেছিল সে সেদিন।

সন্ধ্যা বেলায় ঘুম ভাঙলো, উঠে অজু করে নামাজ টা শেষ করতেই বোনটা এসে বললো - আপু, চলো ছাদে যাই। আমি ধমক দিয়ে বললাম - এই সন্ধ্যা বেলায় ছাদে?কেনো? ও আমার ধমক তোয়াক্কাই করলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ছাদে। শেষ সিঁড়িটা পার করে ছাদটাতে পা ফেলতেই মনে হলো একটা স্বর্গে আছি আমি। এত সুন্দর! কিছু বলার মত ভাষা যেনো লোপ পেয়েছিল আমার। পেছন থেকে "শুভ জন্মদিন"বলে উঠলো আমার প্রিয় কন্ঠটা। ঘুরে দাঁড়িয়েই কেঁদে দিয়েছিলাম সেদিন। আমার এই এক বদভ্যাস,বেশি খুশি সামলে উঠতে পারি না, ছোটো বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলি। আমাকে কাদতে দেখে আমার প্রিয় মানুষটা এগিয়ে এলো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো - এই পাগলী, এইভাবে কাদলে মানুষ কি বলবে?" এত লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন।

একটা ছেলে এতকিছু কিভাবে পারে আমি সত্যিই জানি না। ভালো রান্না করতে পারে,সুন্দর গান গাইতে পারে, কবিতা লিখতে পারে,মানুষের মন মুহূর্তে ভালো করে দিতে পারে....আরো কত কি! ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এইসব ভাবছিলাম। সেদিন আমার হাত ধরে আমাকে কথা দিয়েছিল সবসময় আমার পাশে থাকবে, আমাকে কষ্ট পেতে দিবে না, একসাথে তাহাজ্জুত পড়বো আমরা, একসাথে নিজেদের সব ইচ্ছা পূরণ করব।"ওর প্রতিটা কথা ও রেখেছিল। আমার তো একটাই ইচ্ছা ওর কোলে মাথা রেখে আমি আমার শেষ সময়টা পার করতে চাই, বার্ধক্যটা ওর সাথে খুব আয়োজন করে উপভোগ করতে চাই।

এই সমস্ত প্রিয় স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ খেয়াল হলো ফজরের আযান দিচ্ছে। হাতের ডান পাশে থাকা ছোটো ড্রয়ারটাতে এখনো খুব যত্ন করে ওর দেয়া সবগুলো চিঠি রেখে দিয়েছি। প্রতিদিন পড়া হয় সেগুলো, একসাথে সুখবিলাস করি আমরা প্রতি সন্ধ্যায়। আমাদের সব প্রিয় স্মৃতিগুলো আমরা এত বছর পরও পুরনো হতে দেইনি। এইসব ভাবতে ভাবতেই ওকে নামাজের জন্য ডেকে তুললাম। ঐযে কথা দেয়া আছে আমাদের। আমরা জান্নাতে একসাথে থাকবো সেই কথা।

ও ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। এত সুন্দর হাসির প্রেমে সেই কবে পড়েছিলাম,এখনো উঠি নি, পড়েই আছি। এইভাবে পড়েই থাকতে চাই শেষ পর্যন্ত। একসাথে অজু করে নামাজ টা পড়ে নিলাম দুইজন। এরপর ওর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যোদয় দেখলাম। ভোরের আলো খানিকটা ফুটে উঠতেই দুজন মিলে ছাদে গেলাম। আমাদের নিজের হাতে লাগানো সবগুলো চারাতে পানি দিলাম, দুজন গল্প করলাম, একসাথে হাসলাম। ছাদ ভরা কবুতর আমাদের, ঐগুলোর সাথে সময় কাটালাম। আজকে আমাদের কারো কোনো কাজ নেই। পুরোটা সময় আমরা একজন আরেকজন এর জন্য বরাদ্দ রেখেছি।

couple-3581038_960_720.webp

এইভাবেই আমাদের প্রতিটা সকাল, দুপুর,বিকেল,সন্ধ্যা আনন্দে কেটে যায়। এতগুলো বছর পরেও কোনো অভিযোগ নেই, কোনো কথা কাটাকাটি হয়নি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করেই অভিমান করি, তখন ঠিক ওই সাত বছর আগের মতোই আমার ডান হাতটায় সে একটা সুন্দর বেলী ফুলের মালা পরিয়ে দেয় আর মুচকি হেসে বলে - "পাগলী,তোমাকে অভিমান করলে দারুন মানায়!"

Image score

Sort:  

পাগলী,তোমাকে অভিমান করলে দারুন মানায়!"-এমন একটা মানুষের স্বপ্নই হয়তো বালিকারা দেখে কিন্তু মনে হয়না এমন মানুষ এই পৃথিবীতে আসলেই আছে!থাকলেও চোখে পড়েনি।

আপনার চোখে যেমন পড়েনি আমার চোখেও কখনো পড়েনি। তবে আপনি কি কখনো স্বপ্ন দেখেন না? অনুভব করে না ? এমন কাউকে আশা করে না ?