শহুরে বৃষ্টি!

in BDCommunity3 months ago

যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছে তাদের কাছে ঢাকা শহরের বৃষ্টি ভাল লাগার কথা না। অন্তত আমার কাছে লাগে না। আমি গাছ-মাটি ছাড়া বৃষ্টির আসল স্বাদ পাই না। ঢাকায় বৃষ্টি বিলাসের উপায়ও নেই। যেখানে হালকা বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি উঠে যায়, মানুষের ভোগান্তি যেখানে চরম, সেখানে বৃষ্টি উপভোগ করতে গেলে সবার রোষানলে পরতে হবে।

আমার কাছে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগের সময়টা সবথেকে পছন্দের। এই সময়টাতে বাতাসের ঘ্রান, টেম্পারেচার, সবকিছু বদলে যায়। বাসায় থাকতে এই সময়টাতে বারান্দায় গিয়ে বসতাম। গাছের অস্থিরতা, তুমুল বাতাসে নিজেকে টিকিয়ে রাখা দেখতে কেমন একটা শান্তি লাগতো। সবথেকে ভালো লাগতো পাতার শব্দ। একেকটা গাছের পাতার শব্দ একেক রকম। ধান খেতের বড় বড় আগাছার উপর দিয়ে যখন বাতাস ছুটে যেত তখন এক ধরণের শব্দ হতো, সেটা আবার দূরের মেহগনির সাথে মিলতো না, কাঁঠাল গাছটার সাথেও না। পাশের তালগাছের পাতার শব্দ বেশ ভারি মনে হতো।

IMG_20231024_143235.jpg

বৃষ্টি যখন শুরু হয়ে যেতো তখন এক দৌড়ে ছাদে। মাঝে মাঝে ছোটটা সঙ্গী হতো। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আম্মুর ফিকে হয়ে আসা বকাগুলা কানে আসতো। আমাদের বাসার আশেপাশে বিল্ডিং না থাকায় বৃষ্টির সাথে প্রচুর বাতাস ফ্রি থাকতো। ঠান্ডা বাতাসের সাথে মানিয়ে নিয়ে ভিজতে কিছুটা সময় লাগতো। মাঝে মাঝে মেঝেতে বসে যেতাম। মেঝে থেকে যেই গরমটা বের হতো সেটা বেশ আরামের। নিচে বসলে আরেকটা সুবিধা হলো পানির ফোঁটাকে কাছ থেকে দেখা। বৃষ্টি মেঝেতে পড়ার সময় একটা সুন্দর ছন্দ হয়, ধীরে ধীরে এটা বাড়ে না হয় কমে। চোখ বন্ধ করে এই জিনিস শুনতেও আরাম লাগে! তবে সবচেয়ে আফসোস লাগতো যেদিন কিছুক্ষণ থেকেই বৃষ্টি শেষ হয়ে যেতো। আম্মুর বকাটা উশুল হতো না!

আমাদের বাসা থেকে কোনো বাঁশঝাড় দেখা যেতো না। বাঁশপাতার শব্দ শুনতে চাইলে সাইকেল নিয়ে ছুটতে হতো। বৃষ্টি শুরুর আগ দিয়ে অবশ্য আম্মু সাইকেল নিয়ে বের হতে দিত না। তাই বের হতাম বৃষ্টি শেষ হবার পরে। বসন্ত আর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এই সময়টাতে রাস্তায় প্রচুর পাতা পরে থাকতো। বৃষ্টির পানি সেই পাতায় জমে অসাধারণ একটা ঘ্রাণ বের হতো। ঝড়ের পর ভেজা পাতার সাথে রাস্তায় ভাঙ্গা ডালপালাও পড়ে থাকতো। ছোট ডালগুলার উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিতে সেই মজা লাগতো। একবার এই কাজ করতে গিয়ে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল!

টিউশন শেষে বাসায় ফিরছিলাম। সন্ধ্যার আগ দিয়ে। বৃষ্টি হয়েছে, খুব সুন্দর ঠান্ডা ফুরফুরা বাতাস। সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি লম্বা খয়েরি শুকনা একটা ডাল পরে আছে। স্বভাবশত ওইটার উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিতে গেছি, মাড়িয়ে দেয়ার এক সেকেন্ড আগে দেখি ডালটা লাফ দিয়ে আমার বরাবর উঠে গেলো। চালু থাকা অবস্থাতেই ভয়ে হুট করে সাইকেল সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল করি সেই ডাল আসলে একটা সাপ ছিল! মাঝ রাস্তা থেকে আমি হুট করে এসে তার উপর দিয়ে সাইকেল উঠিয়ে নিয়ে যাবো এটা হয়তো সে কল্পনাও করেনি! তাই সরে যাওয়ার সময়টা পায় নি। বেচারা এভাবে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে না উঠলে নির্ঘাত মারা পরতে হতো। তবে মজার বিষয় হলো আমি আজ পর্যন্ত কোনো সাপকে এত বড় খাড়া লাফ দিতে দেখিনি, এমনকি টিভিতেও না! জান বাঁচাতে প্রাণীকুল কিনা করতে পারে!

তো যেখানে ছিলাম, বৃষ্টি বিলাস। বৃষ্টি শুরু হলেই যেখানে ছাদে দৌড় দিতাম সেখানে শহরের বৃষ্টিকে জানালা দিয়ে ছুতেও ভয় করে। দূষিত বাতাসের অ্যাসিড বৃষ্টিকে ভালবাসা কঠিন! এখানে বৃষ্টি শুরুর আগের দখিনা বাতাস খাওয়ার জন্য জানালা খুলে রাখা যায়না। কিছুক্ষণ খুলে রাখলে একটু দূরের আন্ডার কন্সট্রাশন বাড়িটা থেকে আসা বালু আর ধুলায় ঘর ভরে যায়। মাটির ঘ্রাণের বদলে সিমেন্টে পানি পড়ার গন্ধ নাকে আসে। তবে আজকের ঝুম বৃষ্টিটা ছিল অন্যরকম। ঢাকার বৃষ্টিও আমাকে তার ফাঁদে ফেলতে পেরেছিল!

আজকে আমার ছিল ভীষণ ব্যস্ত একটা দিন। অফিসের কাজ শেষ করে এসে ইফতারির আলুর চপের জন্য কেবল আলু সিদ্ধ বসিয়েছি। এমন সময় নামলো ঝুম বৃষ্টি। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম এতদিন শহরে যেই বৃষ্টি দেখেছি তার থেকে আজকেরটা একটু আলাদা। বা হয়তো আগে এত ভালো করে খেয়াল করা হয়নি।

পুরো আকাশ কালো করে বাতাস ছুটিয়ে নেমেছে বৃষ্টি। বাসার পাশে রেললাইন। বৃষ্টিতে রেললাইনের পাশে থাকা বাচ্চারা ছুটাছুটি করছে। ছোট একটা মেয়ের ময়লা হলুদ ফ্রক আর উঁচু করে বাঁধা এক ঝুঁটি ভিজে একাকার। খানিকক্ষণ একলা ভিজে খালি গায়ে থাকা অন্য পিচ্চিদের সাথে খেলতে চলে গেলো। পাশেই একটা টং দোকান। অন্যান্য সময় দোকানের সামনে বেঞ্চে খদ্দেররা বসে থাকলেও আজকে সব দোকানের ভেতরে জুবুথুবু অবস্থায় দাঁড়ানো। দোকানের সামনে সিমেন্ট বোঝাই করা এক ভ্যান। চালক হয়তো দোকানের ভেতরেই ঠাই নিয়েছে। একটু সবুজের সন্ধান করতে গিয়ে দেখি দোকানের পিছনেই একটা কড়ই গাছ আছে। আশপাশে দশ বারোটা কলা গাছ। ঝড়ের বাতাসের তীব্রতা বুঝা যায় বড় গাছ দেখলে, আমার সেই শখ এইখানে এই একলা দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছটা পূরণ করছে। বাসার সামনে একটা বাগান বিলাস আছে। গরমকাল চলে আসলেও বাগানবিলাসের ফুলগুলা এখনও তরতাজা। বৃষ্টির পানিতে ডালগুলা নুয়ে পাশের বিল্ডিং এর কার্নিশে শুয়ে আছে। ম্যাজেন্টা রঙের বাগানবিলাস দেখতে এমনিতেই সুন্দর, বৃষ্টিতে রঙটা আরও খুলে গেছে।

অ্যাসিড বৃষ্টির ভয়ে শুরুতে না ভিজলেও কিছুক্ষণ পর রেলিংএর বাইরে হাত বাড়ালাম। ঠান্ডা আরাম আরাম পানি। হালকা বৃষ্টির ছাঁটে যতটুকু ভেজা যায় সেইটুকু নিতেই দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর মনে হলো বারান্দার ওপাশে থাকা গাছগুলাকে এদিকে নিয়ে আসি। বাসা থেকে আনা গাছগুলা ঢাকার মাটি-পানিতে অভস্ত হয়ে উঠতে পারছে না। শুকিয়ে জিরজিরা অবস্থা। বৃষ্টির পানিতে একটু যদি প্রাণ ফিরে!

IMG_20240319_152108.jpg

মাঝ দিয়ে একবার একটা ট্রেন ছুটে গেলো। কিছুক্ষণ পর পর যেতে থাকা ট্রেনের শব্দ মাঝে মাঝে খুব বিরক্তিকর ঠেকে। আজকে বৃষ্টির শব্দের সাথে ট্রেনের ঝনঝনানিও ভালো লাগলো। পাশের বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশনের শব্দ আসছে না, কাজ বন্ধ। প্রতিদিন ঝগড়া করতে থাকা দুই বিড়ালও আশপাশে কোথাও গিয়ে হয়তো লুকিয়েছে। অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি শেষ হলো। বাইরে থাকা আমার হাত যখন ভেতরে ঢুকালাম দেখি প্রায় বরফ হয়ে গেছে। চুলায় থাকা আলু সিদ্ধর কথা মনে পড়লো। না, পোড়া লাগেনি।

বৃষ্টিটা শেষ হওয়ার পর মনে হলো কর্মব্যস্ত দিনের মধ্যে দিয়ে এই এক ঘন্টা মনে হয় অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছিলো। এতসব কাজের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টিটা আমার আশপাশ উপভোগ করার সুযোগ করে দিলো। ভাবি, আমার মতন এই এলাকার অন্যরাও কি বৃষ্টি আসলে বাইয়ে তাকায়? বৃষ্টি কি তাদেরকেও ভাবায়? বৃষ্টি হয়তো তাদের কাছে অন্যরকম। রাস্তার ময়লা পানি পাড়ায় বাসায় এসে বৃষ্টি বিলাস কেউ করে না। চাইলেও বৃষ্টির জন্য ভালবাসা এই শহর সহজে আনতে দেয় না। কর্মজীবী মানুষেরা অফিস করে এই শেষ বিকালে বৃষ্টি চায় না। অপরিকল্পিত এই শহরে বৃষ্টি উপভোগ্য না, হয়তো ঝামেলার প্রতিশব্দ।