"পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা"- রিভিউ

in BDCommunity7 days ago

বাবর আলীকে ভালোমতন চিনলাম তার এভারেস্ট জয়ের অভিযান দিয়ে৷ এভারেস্টের যাত্রা পথের কাহিনী পড়ে ওনার উপর আগ্রহ বাড়লো। বিয়ের পর দেখলাম ত্বহাও ওনার ফ্যান। সেই সুবাদে তার লেখা বই গুলাও ওর কাছে আছে। সেখান থেকেই "পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা" বইটা নিয়ে পড়া শুরু করলাম।

বইটা মূলত একটা দিনলিপি। ২০১৯ সালে ৬৪ জেলা ঘোরার পুরোটা সময় এই দিনলিপিতে লেখা আছে। মাত্র ৬৪ দিনে ৬৪ টা জেলা পার করা বিশাল ব্যাপার! ভোরের আলো ফুটার সময় থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন একটানা হেঁটে এসে রাতে আবার ডায়েরি লেখার মতন সময় বের করা, তারিফ করতে হয়! যাত্রাপথে রাস্তার হিসাব রাখতে গুগল ম্যাপ আর হাটা সংক্রান্ত রেকর্ড রাখতে এন্ডৌমন্ডো অ্যাপ ব্যবহার করতেন।

বাবর আলী ঘোরার জন্য শীতকাল বেছে নিয়েছিলেন। এই দেশ চক্কর দেয়ার জন্য শীতকালই মামানসই। এরপর চরম আবহাওয়া (তখন বুলবুল ঘূর্ণিঝড় চলছিল) বা শরীর খারাপ কোনটার জন্যই একদিনও বিশ্রাম নেননি। এত সুন্দর ডিটারমিনেশনের জন্যই হয়তো আজ পর্যন্ত নেয়া তার সব মিশনই সাক্সেসফুল! এর আগে সাইকেলে চড়ে ৬৪ জেলা ঘুরেছিলেন, সঙ্গী নিয়ে। আর এবার পায়ে হেঁটে, একলা পথে। তার জার্নির মোটো ছিল "Say no to single use plastic " ওনার কথা মতে, আমার এই স্লোগানে একজন মানুষও যদি ওয়ান টাইম গ্লাস বা পলিথিন ব্যবহার কমিয়ে দেয় তাহলেই আমি সার্থক। আর তার প্ররিশ্রম দেখে যাত্রা পথে অনেকেই বলেছেন তারা আর ওয়ান টাইম প্লাস্টিক ব্যবহার করবেন না।

ডাক্তার মানুষ হয়ে এই ধরণের দেশ ভ্রমণের নেশা কেনো- এই প্রশ্নের সামনা সামনি হয়েছে অনেকের থেকেই হয়েছেন। প্রতিবারই ধৈর্য নিয়ে উত্তর দিয়েছে।
বাবর আলী তার এই যাত্রায় স্পনসর নিতে চান নি, তাই ভ্রমণ পথে রাতে থাকার ব্যবস্থার জন্য সরকারি ডাক বাংলো নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে খুব রূঢ় আচরণ পান। পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয়ার পর দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই এগিয়ে আসে। এবং দেখা যায় প্রতিরাতেই তাকে আশ্র‍য় দেয়ার জন্য মানুষ ঠিক হয়ে গেছে। এমনও হয়েছে যে এক জায়গায় ২/৩ জন কাছের মানুষ থাকে। পরে কষ্ট করে একজনের বাসা বেছে নিতে হয়েছে।

আমার কাছে ভালো লেগেছে দেশের প্রকৃতি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ। একেকটা জেলা, সেখানকার মানুষ নিয়ে বুঝতে গেলে পায়ে হেঁটে ঘুরলে সবচেয়ে বেশি জানা যায়। ওনার লেখা সহজ, সাবলিল ভাষায়, সাথে আছে হাস্যরস। সেই সাথে ফটোগ্রাফার হওয়ায় ছবিও তুলেছেন বেশ। প্রতিদিনের লেখার সাথে একটি করে তার তোলা ছবিও যুক্ত করেছেন।

IMG_20251124_201345.jpg

কাঁধে ব্যাগ, পায়ে চপ্পল আর মাথায় ক্যাপ দেখে রাস্তায় অনেকেই তাকে পাগল, সন্ন্যাসী, বিকাশের এজেন্ট, সেলসম্যান এমনকি বিদেশিও ভেবেছে। রিকশা বা গাড়ি না নিয়ে মেইন রোড ধরে কেন সে হেঁটে যাচ্ছে এই কৌতুহল ছিল সবার। বাঙ্গালী এমনিতেই বেশি উৎসুক জাতি। তাই তাকে পথে ভোগান্তিও পেতে হয়েছে খুব।
সেই সাথে ছিল প্রতিটা জেলার মানুষের আন্তরিকতা। দুই একদিন ছাড়া প্রতিদিনই তাকে রাতের খাবার এবং সকালের নাস্তা করিয়ে সবাই বিদায় দিয়েছে। যার জন্য সব মিলিয়ে খরচও হয়েছে খুব সামান্য, ৫০০০ টাকার মতন।

এছাড়া কিছু কিছু জেলায় থাকা কাছের মানুষরা অনেকেই তার যার যার সাধ্যমতন তার হাঁটার সঙ্গী হয়েছিলেন। প্রতিদিন তার হাঁটার এভারেজ দুরত্ব ছিল ৪০ কি.মি.। এই দুরত্বটা আসলে কত বড় এটা বুঝেছি উনি যখন আমার এলাকায় এলেন। আশুলিয়া থেকে মানিকগঞ্জ একদিনে তিনি পার হয়েছিলেন। গাড়িতে গেলেও এই রাস্তা ৩/৪ ঘন্টার মতন। হাঁটার কথা কল্পনাও করতে পারিনা! মনের জোরে মানুষ আসলেই অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারে!

সব জেলার কাহিনী শুনে সবচেয়ে ভালো লেগেছে নীলফামারী আর সৈয়দপুর। যাবার ইচ্ছা খুব। দেখা যাক, কবে সুযোগ হয়!

উনি যখন তেঁতুলিয়া থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন তাকে ছবি তুলে দেয়ার জন্য ভ্যানচালকের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আর টেকনাফে তার শেষ দিনে এত মানুষ তাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল যে হিমশিম খেতে হচ্ছিল!

বইটা শেষ করে মনে হলো বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, মানুষ নিয়ে গবেষণা করতে গেলে এই এটা একটা ভালো সোর্স হিসেবে কাজে লাগবে।

প্রতিটা জেলার প্রকৃতি, আশপাশ সবকিছুই না ঘুরে এত সহজে জেনে যাচ্ছি দেখে পড়তে খুব আরাম লাগছিল। ওনার ভাষায় -"সত্যিকারের ভ্রমণ না হোক, মানসভ্রমণ করে হলেও দুঃখ কিছুটা প্রশমিত হোক!” ঘুরার নেশা আমার মধ্যেও প্রবল বলে বইটা শেষ হওয়ার পর খুব মন খারাপ লাগছিল। এধরণের সুযোগ যদি আমিও ম্যানেজ করে নিতে পারতাম! ইশ!