আশা ভঙ্গ হলে জন্ম নেয় নিরাশা। আজ আমি একটি আশা-নিরাশার গল্প শোনাবো। আমার শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। গল্পটা একদম বাস্তব সত্য। সঙ্গত কারণে নাম উল্লেখ করলাম না...
তদন্ত কমিটি
আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে অধ্যক্ষ স্যার আমাকে একটি তদন্তের দায়িত্ব দেন। এক ছাত্র সম্পর্কে গুরুতর কিছু অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ করেছে তার সহপাঠীরা। টাকা এবং মোবাইল চুরির অভিযোগ।
তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম- ছেলেটি মাদকাসক্ত। এমন কোন নেশা নাই, যা সে করে না। খুব রাগ হল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্টুডেন্ট যখন নেশা করে, তখন আমি যেন দেখতে পাই- কতগুলো স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি তার বাবাকে কলেজে আসতে বললাম।
জীবন-সংগ্রামী বাবার আশা নিরাশার গল্প
আসার পর তার বাবাকে দেখে আমরা বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। একেবারেই অপ্রত্যাশিত। উনি খুবই নিম্নবিত্ত একজন মানুষ। একটা ছেড়া জামা আর ময়লা লুঙ্গি পড়ে চলে এসেছেন কলেজে। বুঝতে পারলাম, এটাই উনার সবচেয়ে ভালো জামা।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিনি সবজি বিক্রেতা। ঠেলা গাড়িতে করে সবজি বিক্রি করে সংসার চালান। ওখান থেকেই ছেলের পড়াশোনার খরচ দেন। আর সেই ছেলে পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাবার কষ্টার্জিত টাকাগুলো নেশার পেছনে খরচ করছে। ভীষণ কষ্ট লাগলো।
মায়া লাগে সেই অভিভাবকের জন্য। অনেক সময় অভিভাবকের গাফিলতির কারণে সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যে অভিভাবক নিজে প্রাইমারি এডুকেশনের চৌকাঠ পার হন নি, তিনি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়া ছেলেকে কিভাবে সামলাবেন?
ক্ষমা এবং কাউন্সেলিং
ছেলেটির অপরাধের যতটুকু প্রমাণ পেয়েছি, কলেজের নিয়ম অনুযায়ী কঠিন শাস্তি দিতে হয় তাকে। কিন্তু এতে তার দরিদ্র বাবার অন্তরে তাকে নিয়ে যে বিরাট আশা ছিল, সেটি ধ্বংস হয়ে যেত।
আমি চাইনি- সেই সবজি বিক্রেতার জীবন সংগ্রামটাকে ব্যর্থ করে দিতে। তাই নিয়মবহির্ভূতভাবে ওই ছেলেকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলাম। অধ্যক্ষ এবং তদন্ত কমিটির অন্যদেরকে বিশেষভাবে সুপারিশ করে শাস্তি মওকুফ করালাম। আমি নিজে তার যিম্মাদার হলাম।
ছেলেটিকে আমি শর্ত দিলাম, প্রতিদিন আমার সাথে এক ঘন্টার জন্য কমপক্ষে বসতে হবে। কাউন্সেলিং শুরু করলাম।
নিরাশার মূল কারণ উদঘাটন
তার সহপাঠীদের কাছ থেকে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলাম। জানতে পারলাম, প্রথমদিকে সে খুব ভালো ছাত্র এবং নামাজি ভদ্রনম্র একজন ছিল। সেকেন্ড ইয়ারে সে তার এক ছাত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। কিছুদিন পরে মেয়েটি তাকে ত্যাগ করে।
সেই কষ্ট ভুলতে সে প্রথমে সিগারেট, তারপর অন্যান্য মাদকসেবন শুরু করে। আর মাদকসেবন করতে গিয়ে এলাকার কিছু বখাটে ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়। তাদের প্ররোচনায় অন্যান্য পাপ কাজেও জড়িয়ে পড়ে।
তখন তার পড়াশোনা শেষের দিকে। রেজাল্টের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। আমি তাকে একটু একটু করে বুঝাতে শুরু করলাম- তার জীবনের মূল্য। সে আর কয়েক মাস পরে ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশের অনেক বড় একটি সম্পদ।
তাকে বোঝালাম, তার বাবার কষ্টের কথা। তাকে নিয়ে উনার স্বপ্ন এবং আশার কথা। যতক্ষণ বোঝাতে থাকি, সে বুঝে। তার চোখে পানি চলে আসে। সে দুঃখ প্রকাশ করে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু যখনই আমার কাছ থেকে দূরে চলে যায়, আবার সে নেশায় জড়িয়ে যায়।
নিরাশার বৃত্ত থেকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা
আমি চাইলে তাকে কোন নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সামনেই তার ইন্টার্নশিপ। নিরাময় কেন্দ্রে দিলে তার একটা বছর নষ্ট হয়ে যেত। তার বাবার যে আর্থিক সামর্থ্য, আরো একটা বছর অপেক্ষা করা উনার জন্য অনেক কষ্টসাধ্য। আমি সেই পথে না গিয়ে চেষ্টা করলাম- নিজেই তাকে ফেরাতে পারে কিনা।
আমি তাকে কয়েকটি কাজ দিলাম..
- প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।
- দ্বিতীয়ত, খারাপ সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে।
- তৃতীয়ত, প্রতিদিন নিজেকে কিছুটা সময় দিতে হবে।
- চতুর্থত, পড়াশুনা শুরু করতে হবে।
- পঞ্চমত, সে যদি পুনরায় নেশা করে আমার কাছে গোপন করতে পারবে না। আমাকে বলতে হবে।
নিজেকে ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম
এই পাচটি কাজ সে ঠিক মত করছে কিনা, তা ফলোআপে রাখলাম।
১. তার রুমমেট এবং আরো কয়েকজন সহপাঠী থেকে তার সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য জোগাড় করতে থাকলাম। জানলাম, সে নামাজ শুরু করেছে।
২. খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করলেও তার সহপাঠীরা তার সাথে মিশে না। যেহেতু তার সম্পর্কে সবাই খারাপ ধারণা পোষণ করে। ফলে সে একা হয়ে গেল। এটা আমাদের সমাজের একটা সমস্যা। কেউ যখন ভালো হতে চায়, অন্যদের যে সাপোর্টটা তাকে দেয়া উচিত, সেটা তারা দেয় না।
৩. সে নিজেকে সময় দিতে শুরু করলো। আমি তাকে কিছু টেকনিক শিখিয়ে দিলাম। বললাম, চোখ বন্ধ করে তার বাবার মুখটা ভাবতে। উনার জীবন সংগ্রামের কথা ভাবতে। তাকে নিয়ে যে আশা পোষণ করেন, সেগুলো ভাবতে। তার মায়ের কথা ভাবতে। আর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভাবতে।
৪. পড়াশোনা শুরু করতে গিয়ে সে হিমশিম খেলো। কারণ এরই মধ্যে সে অনেক পিছিয়ে গেছে। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি তাকে আমার সময় উম্মুক্ত করে দিলাম। সেই সাথে অন্য স্যারদেরকেও বললাম, তাকে যেন সহযোগিতা করে। সে বিভিন্ন টিচারের কাছে গিয়ে পড়া বোঝার চেষ্টা করত। আসলে নেশা করলে মেধা কমে যায়। তার বোঝার ক্ষমতা কিছুটা কমে গিয়েছিল। সহজে পড়া ধরতে পারতো না। কিন্তু সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
৫. পঞ্চম কাজটা করতে গিয়ে সে খুব সমস্যায় পড়লো। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা আমার জন্যও বিব্রতকর। সে আমার কাছে এসে বলতো, গতকাল নেশা করেছে। আমার অস্বস্তি হত, কিন্তু সেটা তাকে বুঝতে দিলাম না। এটা করেছিলাম, যাতে সে একটা জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে। তার মনে যেন এই উপলব্ধি আসে- কারো না কারো কাছে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। আর এই উপলব্ধি থেকে যেন একটা অনুতাপ জাগ্রত হয়।
আমার মেথডোলজি এবং মূল্যায়ন
মাদকাসক্ত নিয়ে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাদের সাইকোলজি সম্পর্কেও খুব একটা ধারণা ছিল না। আমি তাকে সংশোধনের জন্য যে পদক্ষেপ গুলো নিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল ধারণাপ্রসূত এক্সপেরিমেন্ট।
আমার আত্মবিশ্বাস ছিল অনেক বেশি। কেন জানি মনে হচ্ছিল, তার সমস্যা মূলত মানসিক। কাউন্সেলিং এবং রুটিনড লাইফ পারে সেই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। আমি শুধু এটাই চেষ্টা করে গেছি আমার সাধ্যমত।
রাতের অন্ধকার কাটিয়ে সূর্যের আলোর ছটা
কাউন্সিলিং দেড় মাস করার পরে আমি ট্রান্সফার হয়ে যাই। চলে আসি নতুন কর্মস্থলে। সেও ইন্টার্নশিপ করতে চলে যায়।
সে ইন্টার্নশিপের ব্যাপারে পরামর্শ চেয়েছিল। আমি তাকে তাদের ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট মেয়েটির সাথে ইন্টার্নশিপ করার জন্য বলি। কথামত সে ইন্টার্নশিপ করতে চলে যায় বেক্সিমকোতে টেক্সটাইলে।
এরপর ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ খুব একটা হয় না। তবে খবরা-খবর রাখতাম। জানতে পেরেছি ইন্টার্নশিপে গিয়ে সে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে। শুনে ভালো লাগে।
আমি কেবল সামান্য অনুঘটক ছিলাম। মূল কাজটি সে নিজেই করেছে। ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা না থাকলে সে ফিরে আসতে পারত না।
সে যে কঠিন সময়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, এর জন্য আমি খুশি। একজন শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কিছুই হতে পারে না।
আশা.. নিরাশা.. প্রত্যাশা..
এখন সে কোথায় আছে, কেমন আছে... জানিনা। হয়তো কোন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে সে এখন মস্ত বড় অফিসার। হয়তো স্যুটেড-বুটেড হয়ে প্রতিদিন অফিস করতে যায়। হয়তো প্রডাকশন বৃদ্ধি করে মালিকের বাহবা পায়। বাবার আশা পূরণ করে মাস শেষে বেতনের টাকাটা হয়তো সেই সবজি বিক্রেতার হাতে তুলে দেয়।
যে নিরাশার জগত থেকে সে ফিরে এসেছে, সেই অন্ধকার পথে যেন পুনরায় না যায়, এটাই আমার প্রত্যাশা।
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম
সখের বশে ব্লগিং করি। ইদানীং কিছুটা আঁকাআঁকি শিখার চেষ্টা করছি।
Hive: @tariqul.bibm
3speak: tariqul.bibm
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলেই প্রতিটা পেশাজীবীদের নিজ নিজ অবস্থান হতে সমাজের জন্য কিছু করার কিছু দেওয়ার থাকে। আর এই শিক্ষকতা পেশায় তা সব থেকে বেশি। আপপি আপপার দায়িত্ব পুংখানুপুঙ্খ ভালো পালন করেছেন। যেটা সবাই করতে পারে না। তাই অপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে। শিক্ষক হিসেবে এটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অনেক সময় আমরা দায়িত্ব পালন করতে পারিনা, অথবা করিনা। ওই ছাত্রের ক্ষেত্রে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। তারও তীব্র ইচ্ছা শক্তি ছিল। তাই সে ফিরে আসতে পেরেছে। ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য।
সেই ছাত্র যে নিজের জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করেছে তার জন্যে তাকেও ধন্যবাদ ।
এটা দুজনের জন্যই অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।
শুকরিয়া যে চ্যালেঞ্জ জয় করতে পেরেছি।
আপনার প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ। এখন কতজন শিক্ষক এটা করে? আপনি করেছেন। অশেষ শ্রদ্ধা।
সকালে চেষ্টা করা উচিত। বিশেষ করে এরকম কেউ যখন ফিরে আসতে চায় আমাদের সবার উচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। অথচ আমরা বেশিরভাগ সময় তাদেরকে তাচ্ছিল্য করি। ফলে তারা আবার ফিরে যায় অন্ধকারে নিরাশার জগতে।
আমিও একমত।
আমি মনেকরি একজন ছাত্রের জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ । আপনি যেটা করেছেন অনেক ভাল করেছেন । আশাকরি আপনার কাজের ধারাবাহিকতা আপনি ভবিষ্যতেও বজায় রাখবেন । ☺❤
চেষ্টা করি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদেরকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে যেতে।
অনেক বড় এক্টা কাজ করেছেন স্যার
ধন্যবাদ ভাই। এটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।