ফেরা

in #love7 years ago (edited)


আজ সকালে একটু বেশী সময় ধরে ঘুমাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু কলিং বেলের শব্দে উঠে পড়তে হল। কাজের ছেলেটা বাড়ি গেছে বলে এই কয়দিন সবকিছু নিজেরই করতে হচ্ছে মিসির আলির। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন হলুদ পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, একগাল হাসি নিয়ে সে বলল, “কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব? আপনাকে দেখতে এলাম।”
মিসির আলি অত্যন্ত একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ, কেউ তাকে দেখলে এলে তাতে আনন্দিত হবার মত কিছু তিনি খুঁজে পান না। এবং তিনি মোটামুটি নিশ্চিত এই ছেলেটা কোনও মতলবে এসেছে, পেছনে আবার মোটা চশমা পড়া একটু বিব্রত গোছের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তি চেপে মিসির আলি বললেন, “ভালো আছি, ভেতরে এসো”।
সোফায় বসা হলুদ পাঞ্জাবী পড়া এই ছেলেটার সাথে আগেও সাক্ষাৎ হয়েছে মিসির আলির। ছেলেটার নাম হিমু, ঢাকার রাজপথে সে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। হিমুর ব্যাপারে মিসির আলির একটা নিজস্ব থিওরি আছে। তার ধারণা হিমু নামের এই ছেলেটার ছোটবেলা কিছুটা অস্বাভাবিকভাবে কেটেছে, সম্ভবত বাবা সংক্রান্ত কোনও সমস্যা ছিল। সেই সমস্যাটা হিমু কখনই কাটিয়ে উঠতে পারে নি পুরোপুরি, হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে খালি পায়ে হেঁটে হিমু তার মানসিক অস্বাভাবিকতা ঢাকতে চায়। মিসির আলি শুনেছেন অনেকেই হিমুকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে, ভয় ও পায়। মিসির আলির মনে হয় হিমুর ক্যামোফ্লাজ সফল, তার অস্বাভাবিকতা সবাইকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করে। মিসির আলির কাছে অবশ্য হিমু কেবলই একটি ইন্টেরেস্টিং চরিত্র, তার সম্পর্কে কোনরকমের অনুভূতির বোধ হয় না তার।
হিমুর সাথে থাকা ছেলেটির দিকে লক্ষ্য করলেন মিসির আলি, এই ছেলেটিকে তিনি আগে দেখেননি। ছেলেটা সম্ভবত চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না, চশমার ফ্রেম খুবই পুরু। এই ছেলেটার মধ্যেও একটা আশ্চর্য রকমের অস্বাভাবিকতা আছে বলে তার মনে হল। কেন এটা মনে হচ্ছে সেটা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলেন না মিসির আলি, আরেকটু পর্যবেক্ষণ দরকার।
“মিসির আলি সাহেব, আপনি ভালো নেই, মিথ্যে কথা বললেন কেন?” – হাসিমুখেই বলল হিমু। মিসির আলি একটু চমকে গেলেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না, বললেন, “এরকম মনে হবার কারণ কি?” উত্তরে হিমু বলল, “কারণ খুঁজে বের করা আপনার কাজ মিসির আলি সাহেব, আমি অনুসন্ধান করি না, অনুভূতি দিয়ে চলি”। “তা কোন অনুভূতি তোমাকে এই খবর দিলো?” প্রশ্ন করলেন মিসির আলি। “আপনার চোখ। বেদনা লুকিয়ে রেখেছেন মিসির আলি সাহেব, কিন্তু ভালোভাবে লুকাতে পারেন নি” এবারে একটু গম্ভীর হয়ে বলল হিমু।
“তোমার হাসিটার মধ্যেও যে কিছু লুকানো আছে সেটা কিন্তু আমিও বুঝতে পারছি হিমু। আর তুমি যে এমনি আমাকে দেখতে আসোনি সেটাও বুঝতে পারছি। কি ব্যাপার বল?” মিসির আলির প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হিমু। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “মিসির আলি সাহেব, আপনি ভালো থাকার চেষ্টা করছেন, ভুলে থাকতে চাইছেন যে সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যার প্রভাব আপনার – আমার এবং আমার পাশে বসে থাকা শুভ্রর উপরও পড়েছে। আপনি যুক্তিবাদী মানুষ, আমাদের মধ্যে আপনারই ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো বুঝার কথা, কিন্তু আপনি গোটা ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
“আমি কি এড়িয়ে যাচ্ছি?” গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন মিসির আলি। “আপনি ভাবছেন উনি ফিরে আসবেন না কখনও। চিরতরে হারিয়ে গেছেন সবার উপর অভিমান করে। কিন্তু উনি ফিরে এসেছেন, সত্যিটা মেনে নিতে পারছেন না বলেই আপনি এভাবে ভাবছেন। শুভ্র, তুমি কিছু বল?” হিমুর কথার শুনে একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করল শুভ্র, “আমি আপনাদের চেয়ে ছোট, খুব বেশী কথা বলাও আমার অভ্যাস না। তবুও হিমু ভাই বলার সাথে সাথেই আমি এসেছি উনার সাথে আপনার বাসায় শুধু আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে। আমাদের সাথে চলুন, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন সবকিছু।”
“কোথায় যেতে হবে?” জিজ্ঞেস করলেন মিসির আলি, উত্তরে শুভ্র বলল, “যেখানে তিনি আছেন। তিনি অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে, তার নির্দেশেই আমাদের এখানে আসা।”
“তোমাদের সাথে তাঁর কথা হয়েছে?” একই সাথে বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে প্রশ্ন করলেন মিসির আলি। উত্তর দিলো শুভ্র, “হয়েছে, তবে সবসময় হয় না, বিশেষ কিছু দিনে হয়, আজ সেই দিন। আজ আমাদের সাথে গেলে আপনিও কথা বলতে পারবেন তাঁর সাথে।” “চলো তাহলে” বললেন মিসির আলি।


শুভ্র গাড়ি নিয়ে এসেছিল, তার গাড়িতে উঠলেন তিনজনেই। ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছলেন তারা। গেট দিয়ে ঢুকার সময় জায়গার নাম পড়লেন মিসির আলি, ‘নুহাশ পল্লী’। আন্দাজ করছিলেন এখানেই আসবেন, অনেক নাম শোনা হলেও এখানে আসা হয়নি আগে কখনও। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলো দুটি অতি রূপবতী মেয়ে। মিসির আলির মনে হল কোনও মানুষের পক্ষে এতো রূপবতী হওয়া সম্ভব না। হিমু বলল, “মিসির আলি সাহেব, ওরা দুজন হল রুপা আর জরি।” রুপা আর জরি হাসিমুখে মিসির আলিকে এগিয়ে নিয়ে গেল বসার ঘরের দিকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, চারপাশ প্লাবিত করে জোছনা নেমেছে। নুহাস পল্লীর খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন মিসির আলি। হিমু আর শুভ্র এসে তার পাশে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মিসির আলি, “কোথায় তিনি?” “আসবেন একটু পরেই” উত্তর দিলো শুভ্র। সামনে এগিয়ে গেলেন তারা, রুপা আর জরি একসাথে গান গাইছে, “ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়….চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়….”, মেয়েদুটো গান গাইতে গাইতে অঝর ধারায় কাঁদছে….হঠাৎ সামনে একটা আলো দেখতে পেলেন মিসির আলি, আলোর মাঝে খুব চেনা একটা মানুষের অবয়ব। “সত্যিই কি আপনি এসেছেন?” ধরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মিসির আলি।
“চান্নিপসরে কে আমারে স্মরণ করে, তাহারে চিনিনা আমি, সে আমারে চেনে” – হাসিমুখে বললেন মানুষটি। “মিসির আলি সাহেব, আপনাকে আমি চিনি, আরও অনেকেই চেনে। আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে প্রচণ্ড বাস্তববাদী মানুষ হয়ে এমন পরাবাস্তবতাকে মেনে নিতে। কিন্তু আপনি নিজেই তো আমার বিদায় মানতে পারেন নি, আপনার মত হাজারও চরিত্রের ভালবাসায় আমি ফিরে এসেছি, আমি ফিরে আসি প্রতি চান্নি পসর রাতে, সৃষ্টির ভালোবাসায় ফিরে আসে স্রষ্টা।”
মিসির আলি আরকিছু ভাবতে পারছেন না, তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝে তিনি শুধু প্রিয় সেই মানুষটার অবয়ব দেখতে পাচ্ছেন। উথালপাথাল জোছনার মাঝে তারও মনে হচ্ছে –
“আমি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরিতে যাই
হাত ভর্তি চাঁদের আলো, ধরতে গেলে নাই……”
Post by Amit Kumar Nath Sir