দুপুরের আহারের পর মন আমার কেমন উদাসী হয়ে পড়ে,পোড়ামাটি -কাঁচামাটি, গ্রামটির সারি সারি তালগাছের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে নিজের মতো ছন্নছাড়ারূপে চলে যাওয়া পথটির বাঁকে জেগে ওঠে স্মৃতির এক টুকরো সাড়া জাগানিয়া ভাব, অনুভবে বারে বারে চিনতে পারা কোন অচেনা হাওয়ার তাল, নিজের অজান্তে ফিরে চলা একটি দিনে, তার সবটুকু ঘটনার কোলাহলে, নীরবে -নিভৃতে যেমন কোকিল ডেকে ওঠে, প্রানের গানের সুরে, সারাবেলা - সব জায়গায় খুঁজে বেড়ানো ভ্রমরের তাল ; এমন একটি দিনে মনে পড়লো কবেকার একটি ঘটনা, হৃদয় মুহূর্তে সিক্ত হয়ে উঠলো।
এর মাঝে অনেক দিন পার হয়ে গেছে, সূর্য চক্কর দিয়েছে সহস্র বার, আকাশের কালো মেঘের দল তৃষার উষ্ণ গ্রীষ্মের দিনে আধমরা প্রকৃতির খটখটে ধড়ে বৃষ্টির ধারা ঝরেছে, মাঠের ফসলের হলুদাভ উৎসবে কত কৃষাণ মুখ ফুটে হেসেছে শত কষ্টের মাঝে, ডাঙার পাশের চিরচেনা মাঠটাতে দুষ্ট শিশুর দল চষে বেড়িয়েছে বাদলার দিনে। কোন এক প্লাবনের স্রোতে ভেসে গিয়েছে নৌকারা,ভেলার পিঠে চড়ে কিশোরেরা বুনো উদ্দমে দূরের তালগাছগুলোর কিনারে তাল কুড়োতে গিয়েছে। হায়, সেদিনগুলোর স্মৃতিপটে যখন মন নিজেকে দেখতে পায়, আঁখিপটে এক বিন্দু ব্যাথার জল জমে ওঠে এখনো।
Source
সন্ধ্যাবেলায় গোধূলির ধূলিতে সারা মাঠজুড়ে কেমন লালিমার সূর্যের রঙ ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন, রাশিরাশি খড়পাতা বিছানো মাটির পথ, ব্যাঙের দল ডিগবাজি খাচ্ছে খেতের ধারে, বিচুলিলতায় কাঁকড়ারা পানিতে নামার উদ্যোগ নিচ্ছে, গরুবাঁধা দূরের এক টুকরো জমিজুড়ে শুনশান বয়ে চলা বাতাসের মিহি ঠান্ডা শীতল ভাব গা জুড়িয়ে দিচ্ছে, কেমন এক অনাবিল সুখের পরশে হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিন।ভাবনার জগতে শুধু একটিমাত্র ইচ্ছার প্রতিভাত, বেলা পড়ে গেল দক্ষিণ দিকের দিগন্তরেখায় চলে যাওয়া পথটা ধরে এগিয়ে চলবো, যেতে যেতে একেবারে শেষ মাথায় এক কুটুমের বাড়ি পৌঁছে যাব। যেই ভাবনা, সেই কাজ।
তখন টর্চলাইট এতো সহজে পাওয়া যেত না গ্রামে গঞ্জের মার্কেটগুলোতে, যদি বা পাওয়াও যেত তার জন্য চড়া মূল্য গুনতে হতো। আমার স্কুল পড়ুয়া সময়, দুরন্ত এক কৈশোরের সময়, যৌবনে তখনো পা দেইনি, বাস্তববোধ মাথায় জাঁক বাঁধার আগে সেই সুবর্ণ সময়টিতে যখন জীবনের কোন চিন্তা মাথায় ফিরতো না, স্বেচ্ছাচারী হয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়ানোর বয়স তখন - যেন এক ফড়িং আমি, কখনো ঘাসে কিংবা বিলের ধারে উড়ে বেড়ানো একটি পতঙ্গ, মুক্ত সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা। একটি ছোট্ট টর্চ পকেটে পুরে, সাথে একটি হ্যাজাক-লন্ঠন হাতে, কিছু মুড়ি মুড়কি সন্দেশ বেঁধে আমার সেই বাল্যকালের ছায়াবন্ধু সহ ঘরের আঙিনা ছাড়লাম।
তখন বর্ষার মৌসুম শেষের পথে, এখন যেমন ভাদ্রের দিন শেষের পথে, আশ্বিনের শুরুর ঘন্টা বাজার অপেক্ষা, তেমনভাবে কিছুটা বন্যার মতো পানি জমেছে সারা মাঠজুড়ে,ফসলের ক্ষেতজুড়ে জলরাশির ঢেউ খেলছে,দূর দিগন্তে সূর্য ডুবছে,কি অপূর্ব দৃশ্য তখন কিনারায়,মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখে যেতে মন চাইবে। মেঠোপথ কখনো সরু, কখনো চওড়া হয়ে চলছে,একধার দিয়ে ফসলের ক্ষেতে বন্যার মাছেরা ভাসছে-ডুবছে, তার পাশ দিয়ে খালের কিনারা পানিতে ডুবে আছে,সীমারেখা মুছে গেছে পানিতে একাকার হয়ে।তার অপর প্রান্তজুড়ে একটি জঙ্গলাবৃত বাগান, বুনো ঝোপঝাড় এসে পড়েছে, শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে, নির্ভীক দুই বন্ধু এগিয়ে চলেছি।
পায়ে হেঁটে চলেছি তো চলেছি, পিছুটান নেই, মাঠের পর জঙ্গল তারপর এক প্রকান্ড মঠ, তারপর আবার পথের শুরু থেকে বয়ে চলা একটি নদী। কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বুড়ো মনোরঞ্জন ধরের বাগানের আম পেড়ে খেয়েছি,অর্ধেক ক্লাস শেষে খুব যত্ন করে বানানো ঢোল সাইজের ঘুড়ি গাব গাছের আঠা দিয়ে বেঁধে উড়িয়েছি পুরো বিকেলে, নতুন আরেকটা কবে বানানো যায়, এ নিয়ে গল্প করতে করতে চলতে লাগলাম। ঘন্টা এক অতিবাহিত হয়েছে কি হয়নি, আমার বন্ধু বলে উঠলো, এবার তবে হালকা জলাহার করা যাক।
ব্যাগ থেকে মুড়ি মুড়কি সন্দেশ বের করলাম, জিলিপিভাজা তখনো মচমচে ছিল বেশ। মিনিট দুয়েকের মধ্যে সব খাবার শেষ হয়ে আসলো, আর আমি বললাম এবার তবে বেরোনো যাক আবার। সন্ধ্যা কেবল জাঁকিয়ে নেমেছে তখন,ঝিঁঝি পোকার দল প্রতিযোগিতায় নেমেছে কিভাবে চেঁচামেচি করে কার থেকে কে বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারে।
হালকা আলো হালকা আঁধার, যেন এক অপরূপ স্থানে এসে পড়েছি। এবার শেষ গন্তব্যস্থলের আগে পেরোতে হবে একটি ডাঙার বাধা, শ্মশানগড়ের পাশ দিয়ে যেটি বয়ে গেছে।
Source
আমার বন্ধুটি দিনের বেলা বড়ো সাহসী হলেও, রাত হলেই সে কিছুটা চুপসে যেত। এটা অন্ধকারের ভয় নয়, ভূতের প্রতি তার কিছু দুর্বলতা ছিল ; তবে সঙ্গে আমি থাকাতে সে মনে একটু সাহস পেল। সে বলে উঠলো,বন্ধু, তাড়াতাড়ি মাঠটা পেরোনো যাক। আমিও বললাম, সে নিশ্চয়ই। হাঁটছি তো হাঁটছি, ঐ দিকটার পাশ দিয়ে যেখানে জ্বলন্ত কয়লা মিটিমিটি জ্বলছিল৷ এমন সময় আমরা দুজনেই যুগপৎ দেখলাম একটা সাদা চাদর ঝুলছে বাঁশঝাড়ের গাছটিতে।
শুনতে পেলাম অস্ফুট গোঙানি গোছের শব্দ, ওরে বাস! আমি শুধু চোখ বড় করে চেয়ে রইলাম।
কান্ডখানা ছিল এই যে আমার সাধের বন্ধুটি এমন জোরে ছুটলো যে, ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে দৌড়াচ্ছে না মাটির পথ, বেচারার খেয়াল নেই। এ দৃশ্য দেখে যতটুকু না ভয় পেলাম, তারচেয়ে বেশি হাসি পেল৷ তাকে থামাই না ডাকি না বুঝতে পেরে শ্মশান থেকেই উল্টা পথে পা বাড়ালাম। কিছুদূর গিয়ে তাকে শান্ত করলাম, বেচারা কি ভয়টাই না পেল!
তারপর কুটুমের বাড়ি যাওয়া রইলো পড়ে, সোজা উল্টোপথ ধরে এগিয়ে চললাম।
ভূত না কি উড়ন্ত চাদর, বোধহয় এত উসাইন বোল্টের ৯.৫২ সেকেন্ডের চেয়েও দ্রুত আমার বন্ধুবরের সেই দৌড়ের সাাথে পেরে ওঠে নি,উল্টো এ দৃশ্য দেখে হয়তো ভূত বাবাজি অবাক হয়েছে।
খুব কষ্ট করে চেপে রাখা হাসিটা দমিয়ে রেখে বাড়িতে পৌঁছালাম সেদিন,তারপর অনেক বছর গড়িয়ে গেছে, সব কোলাহল ভেঙে নীরবতায় বিলীন হয়ে গেছে,তবু ঘটনার রেশ রয়েছে ঠিক তেমন, একটি দিন তেমনি মনে দাগ কেটে রইলো...।
Source
এ তো দেখি কাল্পনিক ভৌতিক অভিজ্ঞতা! কথায় আছদ না, বনে বাঘে খায় না, মনেফ বাঘে খায় জিনিসটা এমন হয়ে গেলো আরকি।😅
হ্যা ,যথার্থ বলেছেন।
তবে ঘটনাটি এখনো মনে পড়ে, অনেক বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো যেন সেদিনের ব্যাপার, পুরনো হয় নি।
ধন্যবাদ 👍
Congratulations @asif7! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 6000 upvotes.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!
Hi @asif7, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @rem-steem!
Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.
JOIN US ON